নিউইয়র্কে ঈদের প্রথম কোলাকুলি

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
প্রকাশিত: ২৪ এপ্রিল ২০২৩, ১৫:০৪
...
২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে ঈদুল ফিতরের জামাত শেষে কোলাকুলি করার মতো আমার একজন পরিচিত লোকও ছিল না মাঠে। এতিম তো আগেই হয়েছি, নিজেকে আরো বেশি এতিম এতিম লাগছিল। নিউইয়র্কে সেটিই আমার প্রথম ঈদ। জুলাই মাসের শেষ দিকে জেএফকে এয়ারপোর্টে নেমে সোজা আপস্টেট নিউইয়র্কের ক্যাটসকিলের অ্যালেনভিলে চলে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধু তারিকুর রহমান শেলির ছোটো ভাই আলোর বাড়িতে। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে রোজা শুরু হয়। আমার কন্যা ফিলাডেলফিয়া থেকে নিউইয়র্কে মুভ করেছিল। কয়েক বান্ধবীর সাথে থাকত উডসাইডে। আমি আসার পর নতুন একটা বাসা ভাড়া নেয় জ্যামাইকায়। আগস্টের শেষ দিকে আমি অ্যানেভিল থেকে চলে আসি। বাপ-বেটি থাকি, রোজা রাখি। হেঁটে হেঁটে নানা জায়গা এক্সপ্লোর করি। জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের (জেএমসি) পথও চিনে ফেলি।

একদিন ভাবলাম, রমজান তো শেষই হয়ে এলো, নিউইয়র্কের মসজিদে কেমন ইফতার হয় অভিজ্ঞতা অর্জন করে আসি। ইফতারের আগে জেএমসিতে আসি। ঢুকতেই দরজার পাশে টেবিলের ওপর ন্যাপকিনে পেচানো একটি খেজুর, এক টুকরা পাউরুটি, ফ্লোরে রাখা পানির বোতল (এখন শরবত, খেজুর, অন্যান্য ফলের টুকরা, ছোলা, পেঁয়াজু, বিরিয়নি/তেহারি/খিচুরিসহ বক্স থাকে)। ইফতারের অবস্থা দেখে শুধু যে বিস্মিত হয়েছি তা নয়, রীতিমতো কান্না পেয়েছে। অহেতুক মেয়েটিকে বাসায় একা ইফতার করার জন্য রেখে এসেছি। ইফতারের অবস্থা যাই হোক, আলহামদুলিল্লাহ বলা উচিত। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ’র পরিবর্তে তওবা আস্তাগফিরুল্লাহ বললাম। এবার তো রোজা শেষই হয়ে গেল, আগামীতেও কোনো রমজানে বেঁচে থাকলে মসজিদে নো মোর ইফতার। গরিবী হালতে বরং বাসায় মেয়ের সাথে ইফতার করব।

যা হোক শাওয়ালের চাঁদ উঠল। পরদিন ঈদ। যেহেতু মসজিদ চিনি, ঈদের জামাত মসজিদে বা আশপাশেই হবে। মসজিদের কাছে আসতেই দলে দলে মুসল্লি মসজিদ ছাড়িয়ে কোথাও যাচ্ছে। তাদের অনুগামী হলাম। এক বিশাল মাঠে ঈদ জামাত হবে। লোকজন সবে আসতে শুরু করেছে, তিন নম্বর কাতারে বসলাম। ভিড় বেড়ে চলল। জেএমসি’র উদ্যোগেই এ জামাত আয়োজিত হয়েছে, তা মাইক্রোফোনে বার বার বলা হচ্ছিল। নামাজের আগে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য বহু লোক ছিল। রমজান ও ঈদ-উল-ফিতরের মহিমা বয়ানের পর বিভিন্ন খাতে চাঁদা আদায়ের জন্যও আলাদা বক্তৃতা। মসজিদ উন্নয়ন, মসজিদ পরিচালিত স্কুলের উন্নয়ন, তারাবিহ পড়ানোর হাফেজ সাহেবের হাদিয়া ইত্যাদি খাত। কাতারের সামনে দিয়ে চাঁদা আদায়কারীরা হেঁটে যাওয়ার সময় মুসল্লিরা সহজে পুলসিরাত পার হওয়ার জন্য সামনে মেলে ধরা বস্ত্রে অর্থ প্রদান করছিলেন। আমি একটা ডলারও দেইনি। তখনো কাজ শুরু করিনি। বাংলাদেশ থেকে নগদ টাকায় কিনে আনা ডলার দেই কি করে। এক ডলার মানে কত টাকা মনে মনে হিসাব করে ফেলি। ডলার আয় না করা পর্যন্ত আমাকে প্রতিটি ডলার বাঁচাতে হবে।

নামাজ হলো, খুতবা হলো, মোনাজাত হলো। সবাতেই উঠে কোলাকুলিতে লিপ্ত। আমি বসে আছি। কোলাকুলি করার লোক নেই। অচেনা লোকের দিকে হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নেয়া যায়? ভিড় কমলে উঠে হাঁটা দেব। ভিড় একটু কমলে উঠলাম। স্যান্ডেল পরে হাঁটতেও শুরু করেছি। পেছন থেকে পাঞ্জাবিতে টান পড়ল। ফিরে তাকালাম। মালেক ভাই। উৎসাহে কোলাকুলি করলাম। মালেক ভাই বাংলাদেশ বিমানের জনসংযোগ বিভাগে ম্যানেজার ছিলেন। ঢাকায় প্রায় প্রতি সপ্তাহে দেখা হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দুই বছরের সিনিয়র হলেও কর্মজীবনে আমাদের ঘনিষ্টতা ছিল। দীর্ঘদিন থেকে মালেক ভাই নিউইয়র্কে। সাপ্তাহিক ঠিকানার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

আমরা সুখ দুঃখের কথা বলতে বলতে মাঠ থেকে বের হয়ে আসি। বহু লোক মালেক ভাইয়ের পরিচিত। পথ চলতে চলতে তারা মালেক ভাইয়ের সঙ্গে কোলাকুলি করেন, তার সঙ্গে আমাকে দেখে আমার সঙ্গেও কোলাকুলি করেন। কাছে এক বাড়িতে যাবেন মালেক ভাই, ঈদের সৌজন্য সাক্ষাৎ, আমাকেও টানেন। আমি ইতঃস্তত করি, অচেনা মানুষের বাড়িতে যাই কি করে! মালেক ভাই বলেন, ঈদের দিন চেনা অচেনা কি। আমি তার সাথে যাই। বাড়ির মালিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, ডা. চৌধুরী সারওয়ারুল হাসান। পেশায় ডাক্তার হলেও একাধিক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক। আরো লোক আসে। আরো কোলাকুলি হয়। উপাদেয় খাবার খেতে হয়। নিউইয়র্কে ঈদের দিন কারো বাড়িতে প্রথম খাওয়ার ঘটনা। মনটা পড়ে থাকে মেয়ের কাছে। মেয়েটা তো এত কিছু রান্না করেনি! খেতে কষ্ট হয়।
সেখান থেকে বের হয়ে মালেক ভাই পাশের বাড়িতে টানেন। কমিউনিটি লিডার নার্গিস আহমেদের বাড়ি। সেখানেও অনেক লোক, অনেক কোলাকুলি। কিন্তু খেতে বসে মেয়ের জন্যে আরো কষ্ট লাগে।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

সর্বশেষ