ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে প্রতিবাদের অধিকার কেন থাকবে না

কামাল আহমেদ
প্রকাশিত: ১৫ জুন ২০২১, ১৩:০৬
...
বৈশ্বিক মহামারি কোভিড–১৯–এর কারণে বড় ধরনের সব সামাজিক আয়োজন বছর দেড়েক বন্ধ থাকার পর শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি–৭-এর শীর্ষ বৈঠক হয়ে গেল, তাকে কেন্দ্র করে আমরা চমকপ্রদ কিছু প্রতিবাদের ছবিও দেখলাম। বিভিন্ন ধরনের স্বার্থ ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বিশ্বনেতাদের বৈঠকগুলোর সময় এ ধরনের প্রতিবাদ অনেক দিন ধরেই করে আসছে। কখনো কখনো তা সহিংসও হয়ে ওঠে, বিশেষ করে নৈরাজ্যবাদীদের জন্য। তবে এবারের প্রতিবাদের আকার ছিল ছোট এবং কোনো সহিংসতা ঘটেনি। তবে বৈচিত্র্য এবং সৃজনশীলতায় কোনো ঘাটতি ছিল না।

শীর্ষ বৈঠকের আয়োজনগুলো ছিল লন্ডন থেকে প্রায় তিন শ মাইল দূরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় কর্নওয়ালের সমুদ্রতটের অবকাশকেন্দ্র সেন্ট আইভসে। ওই অবকাশকেন্দ্র ঘিরে অত্যন্ত সুরক্ষিত একটি এলাকা তৈরি করে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতাধর নেতাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। আর প্রতিবাদকারীদের জন্য নির্ধারিত ছিল কিছুটা দূরবর্তী সমুদ্রতট এবং শহর। স্বাস্থ্য অধিকার, পরিবেশবাদী, পরমাণু নিরস্ত্রীকরণপন্থী, যুদ্ধবিরোধী, মানবাধিকারকর্মী, এনজিও কর্মী, ট্রেড ইউনিয়ন সদস্য, ফিলিস্তিন ও কাশ্মীরের সমর্থকদের আলাদা অনেকগুলো প্রতিবাদ-বিক্ষোভ আয়োজিত হয়।

সাগরের পানিতে সাঁতার কেটে, নৌকা নিয়ে, সৈকতে বালুর মধ্যে নেতাদের প্রতিকৃতি এঁকে, নেতাদের নানা রকম ক্যারিকেচার বা ব্যঙ্গ চরিত্র তুলে ধরা বেলুন বানিয়ে প্রতিবাদগুলো অনেকটাই বর্ণাঢ্য হয়ে ওঠে। তবে এর মধ্যেও বহুজাতিক কোম্পানি ম্যাকডোনাল্ডে অবস্থান গ্রহণ, জীবাশ্ম জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের প্রতিবাদে এইচএসবিসি ও বার্কলেস ব্যাংকের দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকার মতো কাজও হয়েছে, যেগুলো আইনত অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।

সম্মেলনের চূড়ান্ত ইশতেহার প্রকাশের পর সেই অবকাশকেন্দ্র থেকে বেরোনোর একমাত্র পথটির মুখেও বাদ্য বাজিয়ে অবস্থান নেয় পরিবেশবাদী গোষ্ঠী এক্সটিংশন রেবেলিয়ন। কিন্তু এদের অপসারণের জন্য কোথাও পুলিশ শক্তি প্রয়োগ করেনি। এর এক দিন আগে, ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে এবং ইসরায়েলি নিষ্ঠুরতা ও দখলদারির প্রতিবাদ এবং দেশটিকে জি-৭–এর দেশগুলোর অব্যাহত সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা বন্ধের দাবিতে ডাউনিং স্ট্রিটের সামনেও বড় ধরনের প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও পুলিশ বাধা দেয়নি।

এসব বিক্ষোভ জমায়েতের দুটো বিষয় খুবই লক্ষণীয়। একটি হচ্ছে আয়োজনগুলো ছিল অনেকটা উৎসবের মতো এবং দ্বিতীয়ত: রাজনীতিকদের জন্য ব্যঙ্গাত্মক। পুলিশের কৌশলের কথাও না বললেই নয়। তাদের কৌশলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা নিবর্তনমূলক ছিল না। নাশকতা এড়ানোর জন্য তাদের জোর ছিল গোয়েন্দা তৎপরতায়। অন্য প্রতিবাদগুলোর মতোই ধারণা করি আইন লঙ্ঘনের জন্য কাউকে বিচারের প্রয়োজন হলে তারা সন্দেহভাজনদের পরে গ্রেপ্তার করবে, যেমনটি অধিকাংশ সময়েই করে থাকে।

২.
আমাদের দেশেও মহামারির মধ্যে সরকারি আয়োজনে বড় জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব হয়েছে গত মার্চে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বর্ষব্যাপী অনুষ্ঠানমালার সমাপনী উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী আয়োজন। বিদেশি অতিথি, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের অংশগ্রহণ নিরাপদ করতে ঢাকা প্রায় অবরুদ্ধ এক নগরীতে পরিণত হয়। পুলিশপ্রধান আগাম ঘোষণা দিয়ে দেন ওই সময়ে কেউ যেন ঘরের বাইরে না বেরোয়। সব ধরনের বিক্ষোভ-সমাবেশ, যা বহুদিন ধরে এমনিতেই হয় না, নিষিদ্ধ করা হয়। বলা চলে বিদেশি অতিথি ও সরকারি আয়োজনের নিরাপত্তার জন্য সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে দমনমূলক কৌশল বেছে নেওয়া হয়। সরকারি আয়োজনগুলোর থেকে নিরাপদ দূরত্বে নির্দিষ্ট জায়গায় প্রতিবাদ-বিক্ষোভের অনুমতি দিলে সেগুলোতে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা যে খুব একটা ছিল, তা মনে হয় না।

নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর দেখা গেল তা উল্টো ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। মতপ্রকাশের অধিকার এবং সভা-সমাবেশের অধিকার যেহেতু আমাদের সংবিধানে নিশ্চিত করা আছে, সেহেতু এ ধরনের নিবর্তনমূলক অধিকার হরণকে বিনা প্রতিবাদে মেনে নেওয়া সব গণতন্ত্রমনা নাগরিকের জন্য স্বাভাবিক নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাই ছাত্রদের একটি অংশ প্রতিবাদ করেছে। প্রায় এক দশকের হামলা-মামলায় বিপর্যস্ত প্রধান বিরোধী দল নিষ্ক্রিয় থাকলেও ছোটখাটো দু-একটি দল সাধ্যমতো প্রতিবাদ জানিয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট কথিত অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। ছাত্রদের প্রতিবাদে পুলিশ লাঠিপেটা করলেও পত্রপত্রিকায় পাল্টা সহিংসতার খবর তেমন একটা আসেনি।

সহিংসতা বড় আকারে যা হয়েছে, তা প্রধানত হেফাজতে ইসলামের সমর্থক, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে। এসব সহিংসতায় প্রাণ হারালেন অন্তত ১৫ জন এবং আহত ব্যক্তির সংখ্যা এর কয়েক গুণ। সহিংসতার আইনানুগ তদন্ত এবং বিচার অবশ্যই হওয়া দরকার। কিন্তু সবকিছু কি আইন মেনে হচ্ছে? সারা দেশে হেফাজতের নেতা–কর্মীদের যে ধরপাকড় হয়েছে, তার সবাই কি মামলার আসামি? নাকি গ্রেপ্তারের পর আসামির তালিকায় নাম ঢোকানো হচ্ছে? আইনের সীমা লঙ্ঘন কারও ক্ষেত্রেই সমর্থনযোগ্য নয়। হেফাজতের নেতৃত্ব নিয়ে সংগঠনটির অন্তর্দ্বন্দ্বে সরকারের যে পক্ষপাত রয়েছে, তার কারণে কেউ যদি অযথা হয়রানির শিকার হন, সেটা হবে অন্যায়।

আরও উদ্বেগের বিষয় হলো কোনো ধরনের সহিংসতায় জড়িত না হয়েও যেসব ছাত্র গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাঁদের প্রতি অবিচার। ৫০ জনের বেশি ছাত্র যাঁরা আটক আছেন এবং যাঁদের জামিনের জন্য প্রধান বিচারপতির দপ্তরে কয়েকজন সুপরিচিত নাগরিক যে অনন্যোপায় হয়ে ধরনা দিতে গেছেন, সেটা মোটেও প্রত্যাশিত নয়। বিদেশি অতিথি, তা সে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশের প্রধানমন্ত্রী হলেও তাঁর বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানানো কোনোভাবেই অজামিনযোগ্য অপরাধ নয় যে তাঁর জন্য তিন মাসেও জামিন মিলবে না। ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার তরুণেরা যদি জীবনের শুরুতেই আদালতের কাছেও রাষ্ট্রীয় হয়রানির প্রতিকার না পান, তাহলে রাষ্ট্রের কোন প্রতিষ্ঠানের ওপর তাঁরা আস্থা রাখবেন?

৩.
প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সংবিধানসম্মত অধিকার। মতপ্রকাশের এই অধিকার ভোগ করার প্রক্রিয়াও সৃজনশীলতায় সমৃদ্ধ হতে পারে, উপভোগ্য হতে পারে। সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনে তার প্রতিফলন আমরা দেখেছি, সাংস্কৃতিক মঞ্চে, কবির কবিতায়, শিল্পীর তুলিতে। বিশ্ব বেহায়ার কার্টুনটি স্বৈরশাসনের বেহায়াপনার ঐতিহাসিক প্রতীক হিসেবে ইতিহাসে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হচ্ছে অসামরিক শাসনকালেই দেশে কার্টুন আঁকার জন্য কার্টুনিস্ট আহমেদ কিশোরকে জেল খাটতে হয়েছে, শারীরিক নির্যাতনের ক্ষত ও যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে ‘রাষ্ট্রবিরোধী পোস্ট, মহামারি করোনা, সরকারদলীয় বিভিন্ন নেতার কার্টুন দিয়ে গুজব ছড়িয়ে’ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও অপপ্রচারের। মামলায় রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করারও অভিযোগ এনেছে পুলিশ।

রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি যে আইনে সংজ্ঞায়িত নেই, সে কথা আগেও আমরা বলেছি। আর আদালত যদি কার্টুনের কারণে রাষ্ট্রের সেই কাল্পনিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের দায়ে কিশোরকে দণ্ড দেন, তাহলে বিশ্বে সেই হবে প্রথম কার্টুনিস্ট, যাকে রাষ্ট্র তার মান রক্ষার জন্য জেলে পাঠাচ্ছে। যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা যদি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ সইতে না পারেন, তাহলে বলতে হবে তাঁরা ভুল পেশায় আছেন। একইভাবে মানতে হবে যে আমরাও সম্ভবত সৃজনশীলতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছি। সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতির অন্যায়-অবিচার, বৈষম্য, অনিয়ম, অপরাধকে বিদ্রূপ করা ভুলে গেছি বা সেই মেধা ও সাহস তিরোহিত হয়েছে। কিছুদিন আগে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ পত্রপত্রিকায় কার্টুনের অনুপস্থিতির বিষয়ে ফেসবুকে আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন।

কিশোরকে আমি চিনেছি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার খবর পড়ার পর। ফেসবুকের বাইরে তাঁর সঙ্গে কখনো পরিচয়ও হয়নি। এ রকম আরও কিছু প্রতিভাধর আঁকিয়ে আছেন। সাংবাদিক রোজিনাকে কারাগারের গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ছবির আদলে মেহেদি যে কার্টুন এঁকেছেন এবং নিউ এজ পত্রিকা তা ছেপেছে, তাতে কিছুটা হলেও আশা ফিরে পাই। এখন অপেক্ষায় আছি দেশে একদিন রাজনৈতিক ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের উৎসব দেখব বলে। অন্যায়-অবিচার-প্রতিবাদের এ রকম উৎসব খুবই জরুরি। এটা সহিংসতার ঝুঁকিও দূর করে।

কামাল আহমেদ সাংবাদিক
প্রথম আলো

সর্বশেষ

সর্বশেষ