‘বাপ কা বেটা’র ছোট ঋতুরাজ সিরিজ বই লিখে গিনেস বুকে
প্রকাশিত: ২৫ এপ্রিল ২০২৩, ১৮:০৪
শুভাশীষ ভৌমিক ১৯ এপ্রিল একটি ই-মেইল পান। তাঁর ৯ বছর বয়সী ছেলে ঋতুরাজ ভৌমিকের জন্য ‘কনিষ্ঠতম সিরিজ বই লেখক (ছেলে)’ ক্যাটাগরির জন্য আবেদন করেছিলেন। ই-মেইলে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে।
এত বড় খবরটি পেয়ে ঘাবড়ে যান শুভাশীষ ভৌমিক। তাই তখনই ছেলেকে এ বিষয়ে কিছু জানাননি। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের ওয়েবসাইটে খবরটি থাকলেও তখন পর্যন্ত ছেলের কোনো ছবি না দেখে একটু থমকেও যান। তারপর ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখলেন, সত্যি তাঁর ছেলের নাম গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে উঠেছে।
শুভাশীষ ভৌমিক এভাবেই জানালেন বিশ্বের দরবারে ছেলের নাম লেখানোর গল্পটি। নিজের ফেসবুকে এই বাবা লিখেছেন, ‘নিজের ছেলের নাম এবং তার পাশে দেশের নামকে বিশ্বদরবারে দেখতে পেয়ে আমার মনে হচ্ছে, এ পৃথিবীতে আমার আসলে চাওয়ার আর খুব একটা কিছু নেই।’
শুভাশীষ ভৌমিক তাঁর ফেসবুক পোস্টে ছেলের জন্য সবার কাছে আশীর্বাদ চেয়ে লিখেছেন, ‘ঋতুরাজের জন্য আশীর্বাদ করবেন যেন ওর পা সব সময় মাটিতে থাকে এবং ও যেন মানুষের ভালোবাসার প্রতিদান বিনয়ের সঙ্গে ফেরত দিতে পারে।’
বর্তমানে দেশের বাইরে থাকা শুভাশীষ ভৌমিকের সঙ্গে সোমবার হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়। বললেন, ‘খবরটি জানার পর আবেগ এবং চোখের পানি আটকে রাখতে খুব বেগ পেতে হয়েছিল।’ ‘গুডউইল ফ্যাক্টরি’ নামে ছেলের দুটো সিরিজ গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মূল্যবোধের ওপর ১০টি গল্প এবং পৃথিবীকে আরও সুন্দর করে মানুষের বসবাসযোগ্য করতে বাচ্চাদের ভূমিকা কী হতে পারে, তা নিয়ে ৭টি গল্প লিখেছে ছেলে।
ঋতুরাজের অন্যান্য অর্জন নেট দুনিয়ায় অবশ্য আগে থেকেই বেশ পরিচিত ঋতুরাজ। শুভাশীষ ভৌমিক ছেলেকে নিয়ে গান করেন ছেলের ছোটবেলা থেকেই। ২০১৯ সালের জুলাইতে ছেলে ঋতুরাজ ভৌমিককে নিয়ে ‘বাপ কা বেটা’ নামে ব্যান্ড গড়েন তিনি। ‘বাপ কা বেটা’ নামে ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল খোলার পর তাও বেশ জনপ্রিয় হয়।
তবে শুভাশীষ ভৌমিক বললেন, খ্যাতির বিড়ম্বনায় ছেলে যাতে ভেসে না যায়, সেদিকে সব সময় নজর রাখা হয়। ইউটিউব বা ফেসবুকে ছেলে কেমন জনপ্রিয়, তা সে জানে না বা তা দেখার সুযোগ নেই তার। তবে ছেলেকে বলা হয়েছে, ভালো কাজ করলে সবাই ভালোবাসবে। বাইরে গেলে বাপ কা বেটার কল্যাণে অনেকেই ছেলেকে চিনতে পারেন, কাছে টেনে নিয়ে আদর করেন। ছেলে এটুকুই বুঝতে পারে, সে ভালো কাজ করছে বলেই মানুষ তাকে আদর করছে।
পেনসিল প্রকাশনী ঋতুরাজ ভৌমিকের ‘গুডউইল ফ্যাক্টরি’র প্রথম বইটি প্রকাশ করে। মহান একুশে বইমেলায় লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ঋতুরাজ। বই কেনার জনপ্রিয় অনলাইন শপ রকমারি ডটকমের উদ্যোগে আয়োজিত ‘নগদ-রকমারি বইমেলা বেস্টসেলার অ্যাওয়ার্ড-২০২২’-এ ছোটদের ফিকশন ক্যাটাগরিতে ‘গুডউইল ফ্যাক্টরি’র জন্য বেস্টসেলার লেখক অ্যাওয়ার্ডও পায় ছোট্ট ঋতুরাজ।
প্রতিভা বিকাশে স্কুলের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ রাজধানীর অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে ঋতুরাজ। শুভাশীষ ভৌমিক ছেলের লেখালেখির কৃতিত্বের ভাগ দিলেন স্কুল কর্তৃপক্ষকে। বললেন, স্কুল থেকে বাচ্চাদের লেখালেখিতে উৎসাহ দেওয়া হয়। বাচ্চারা বিভিন্ন বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা নিজের ভাষায় লেখে। এভাবেই ঋতুরাজের লেখালেখির শুরু। এ ছাড়া স্কুল কর্তৃপক্ষ ঋতুরাজ এবং অন্যদের উৎসাহিত করার জন্য ঋতুরাজের বই কিনে তা স্কুলের লাইব্রেরিতে রেখেছে।
শুভাশীষ বললেন, স্কুল কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি বাসাতেও ছেলেকে লিখতে উৎসাহ দেওয়া হয় সব সময়। ভালো লিখলে তা বই হিসেবে প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। বই প্রকাশের পর বইমেলায় গিয়ে ছেলে যখন দেখল, মানুষ বইটির প্রশংসা করছে, বিষয়টি তার ভালো লাগে। ছেলে এখনো এটাই বিশ্বাস করে, শুধু ভালো কাজ করলেই মানুষ প্রশংসা ও আদর করবে।
খ্যাতির বিড়ম্বনায় ছেলে যাতে ভেসে না যায় ঋতুরাজের গিনেস বুকে রেকর্ড করার বিষয়ে শুভাশীষ বলেন, দ্বিতীয় বই প্রকাশের পর গিনেস বুকে রেকর্ডের জন্য আবেদন করার বিষয়টি মাথায় আসে। কাজটি অনেক ঝক্কিঝামেলার ছিল। অনেক কিছু যাচাই–বাছাই করে কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ই-মেইল পাওয়ার পর নিজে সব যাচাই–বাছাই করে তারপর ছেলেকে জানানো হয় এ খবর। তিনি আরও বলেন, ‘ছেলের কেমন অনুভূতি হয় এ খবর শুনে, তা দেখার জন্য ভিডিও করি। তা ফেসবুকে পোস্টও করেছি। ছেলে খুবই অবাক হওয়ার পাশাপাশি অনেক খুশি হয়েছে। এত বড় খবর শুনে ছেলের পা মাটিতে থাকবে তো—এ চিন্তাটাই প্রথম মাথায় এসেছে। আমরা চাই না, ছেলে খ্যাতির বিড়ম্বনায় ভেসে যাক।’
শুভাশীষ ভৌমিক বলেন, ‘ছোট থেকেই ছেলেকে কেমনে স্বপ্ন দেখতে হয়, তা শেখাতে চেষ্টা করেছি। স্বপ্ন দেখা শুরু করলে তা কোনো না কোনো সময় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে এবং অর্জন যত বড়ই হোক, তা বিনয়ের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে—এটাই সব সময় বলি ছেলেকে।’ তিনি বলছিলেন, ঋতুরাজ ভৌমিক সেনাবাহিনীর অফিসার হতে চায়, কখনো হতে চায় উদ্যোক্তা। গান গাইতে পছন্দ করে। গিটারও ভালো বাজায়।
শুভাশীষ ভৌমিক বলেন, ছেলেকে কখনোই কোনো কিছু করতেই হবে—এভাবে জোর দেওয়া হয় না। তবে গান, লেখালেখি, বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে ছেলেকে পরিচিত করানোর কাজটি করা হচ্ছে সচেতনভাবে। গান গাইতে হলে নিয়মিত রেওয়াজ করতে হবে—ছেলেকে দিয়ে তা করানোও হয়। অর্থাৎ ছেলে যা–ই করুক, তা যাতে নিয়মের মধ্যে থেকে করে, সেদিকে নজর রাখা হয়। তারপর ছেলে বড় হয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বা নিজের পছন্দটাকে বেছে নেবে।
শুভাশীষ ভৌমিক পেশায় প্রকৌশলী, অস্ট্রেলিয়ান একটি কোম্পানিতে বাংলাদেশের দেশীয় পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। ঋতুরাজের মা মৌসুমী সাহা গৃহিণী। এ দম্পতির ঋতুরাজই একমাত্র সন্তান। এ পরিবারের সদস্যরা দেশ–বিদেশে ঘুরতে পছন্দ করেন। আর বেড়ানো শেষে ঋতুরাজের দায়িত্ব থাকে নতুন জায়গায় বেড়ানোর অভিজ্ঞতাটা তার মতো করে লিখে রাখা।
শুভাশীষ ভৌমিক বলেন, ‘ঋতুরাজের বই থেকে লেখকের ভাগের পাওয়া সব টাকা আমরা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের দিয়ে দিই। ইতিমধ্যে প্রথম বইয়ের সব টাকা দিয়ে দিয়েছি।’
শুভাশীষ ভৌমিক জানান, তিনি ভাগ্যবানদের মধ্যে একজন, যিনি মা–বাবার কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়ে বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর মা–বাবাও কোনো কিছু চাপিয়ে দেননি। আর এখন রাজধানীতে ঋতুরাজ তার দাদা–দাদির সঙ্গে যৌথ পরিবারে বড় হচ্ছে। শুভাশীষ বলেন, ‘ঋতুরাজকে আমার মা–বাবা সময় দিচ্ছেন বলেই আমরা দুজন ছেলের বিভিন্ন শখের বিষয়ে নজর দিতে পারছি।’