যেভাবে ডুবলেন ও দলকে ডোবালেন লিজ ট্রাস

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশিত: ২১ অক্টোবর ২০২২, ১১:১০
...

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে সৃষ্ট অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থার মধ্যে গত ৬ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা লিজ ট্রাস। মাত্র দেড় মাসের মাথায় প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হলেন তিনি। কী কারণে লিজ ট্রাসের এই পরিণতি, তার একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা। বিশ্লেষণটি বাংলা অনুবাদ করে প্রকাশ করা হলো।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসার মাত্র দেড় মাসের মাথায় পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন লিজ ট্রাস। ঘোষণাটি এল গত সোমবার দেশটির নতুন অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্টের নেওয়া কিছু পদক্ষেপের পর। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ট্রাস যেসব অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেগুলো খারিজ করে দেন হান্ট।

হান্টের পদক্ষেপগুলো যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে কাজে দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে সেগুলো ট্রাসের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের কারণ হয়ে দাঁড়াল।যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক নিকোলাস অ্যালেন বলেন, ট্রাস ক্ষমতায় আসার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সময়ের অশান্ত অবস্থা শেষ হবে বলে মনে করা হচ্ছিল। তবে আদতে তা হয়নি। ট্রাসের নেতৃত্বকালে বিশৃঙ্খলা যে গতিতে বেড়েছে, তা যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে আগে কখনো দেখা যায়নি।  

লিজ ট্রাস এমপি নির্বাচিত হয়ে প্রথম যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে যান ২০১০ সালে। ডেভিড ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ২০১৪ সালে তিনি দেশটির পরিবেশ, খাদ্য ও পল্লি উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হন। এরপর থেরেসা মে ও বরিস জনসনের সরকারে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ২০২১ সালে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন ট্রাস।

গত জুলাইয়ে বরিস জনসন পদত্যাগ করার পর ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব কে দেবেন, তা নিয়ে দলটিতে ভোটাভুটি হয়। সেখানে ট্রাসের পক্ষে ৫৭ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট পড়ে। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ঋষি সুনাক পেয়েছিলেন ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট। ভোটে জয় পেয়ে দলের প্রধান হিসেবে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হন ৪৭ বছর বয়সী ট্রাস।

লিজ ট্রাস যখন ক্ষমতায় এলেন, তখন যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির অবস্থা ছিল টালমাটাল। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞায় জ্বালানি তেলের যে মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে, তার বিরাট প্রভাব পড়েছে যুক্তরাজ্যে। দলীয় ভোটের প্রচারণায় জ্বালানির দামে লাগাম টানার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ট্রাস। এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে গিয়ে নানা পরিকল্পনার আশ্রয় নেন তিনি। সেগুলোর একটি গত শতকের আশির দশকে বেশ সফলভাবেই কাজে লাগিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান। দুজনকেই আদর্শ মানেন লিজ ট্রাস।

পরিকল্পনাটি হলো করহার কমানো, বিশেষ করে ধনীদের জন্য কর কমিয়ে তাঁদের বিনিয়োগে উৎসাহী করা। একই পরিকল্পনা নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রেও কাজে লাগবে বলে মনে করতেন লিজ ট্রাস। তাঁর ধারণা ছিল, এতে করে যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে।  
বাজারে অস্থিতিশীলতা

লিজ ট্রাসের মন্ত্রিসভায় প্রথম অর্থমন্ত্রী করা হয়েছিল কোয়াজি কোয়ার্টাঙকে। কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি ট্রাসের ওই পরিকল্পনাগুলোই একটি সংক্ষিপ্ত বাজেটের মাধ্যমে উত্থাপন করেন। এতে দেশটির মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। পড়ে যায় ব্রিটিশ পাউন্ডের দাম। বিনিয়োগকারীদের সরকারি বন্ড ছেড়ে দেওয়ার হিড়িক পড়ে।

এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে বন্ড কিনতে শুরু করে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড। এরই মধ্যে আবার বাড়তে থাকে গৃহঋণের সুদ। আগে থেকেই জীবনযাপনের খরচ জোগাতে হিমশিম খাওয়া যুক্তরাজ্যবাসীর কাছে তা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ায়।

একপর্যায়ে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড বন্ড কেনা বন্ধ করার ঘোষণা দেয়। ব্যাংকটির এই সিদ্ধান্তের জেরে কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন লিজ ট্রাস। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে কোয়াজি কোয়ার্টাঙকে সরিয়ে দেন তিনি। এরপর করপোরেশন কর না বাড়ানোর পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন। অথচ এই সিদ্ধান্তকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বাধা হিসেবে চিহ্নিত করতেন তিনি। ট্রাসের এই ভোলবদল তাঁর গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে।  

যেদিন কোয়াজি কোয়ার্টাঙ পদত্যাগ করেন, সেদিনই অর্থমন্ত্রী হিসেবে জেরেমি হান্টকে নিয়োগ দেন লিজ ট্রাস। জেরেমি হান্ট গত সোমবার ট্রাসের অনেক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাতিলের ঘোষণা দেন। ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের রাজনীতিবিষয়ক জ্যেষ্ঠ প্রভাষক লুইস থমসন বলেছেন, অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বিষয়ে লিজ ট্রাসকে আগেই অনেকে সতর্ক করেছিলেন। তবে তিনি তা কানে তোলেননি বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

লুইস থমসনের ভাষ্য, লিজ ট্রাস কনজারভেটিভ সরকারের অনেক অভিজ্ঞ উপদেষ্টাকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। তবে সেরা প্রধানমন্ত্রীদেরও আশপাশে এমন লোকজন থাকা প্রয়োজন, যাঁরা তাঁদের পরিকল্পনাগুলো চ্যালেঞ্জ করতে পারেন।সেখানে হান্টকে অর্থমন্ত্রী করার আগপর্যন্ত ট্রাসের সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা বলার মতো কেউ ছিলেন না।  

জেরেমি হান্ট যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দিয়েছেন, সেখানে লিজ ট্রাসের মোট ৪৫ বিলিয়ন পাউন্ড কর ছাড়ের পরিকল্পনার বেশির ভাগই বাতিল হয়েছে। ট্রাস সরকারের সংক্ষিপ্ত বাজেটে আগামী দুই বছরের জন্য নাগরিকদের বিদ্যুৎ বিলের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। এতে সরকারের ওপর ১০০ বিলিয়ন পাউন্ড খরচের বোঝা চাপত। তবে হান্ট বলেছেন, দুই বছর নয়, আগামী এপ্রিল পর্যন্ত এ নিয়ম চালু থাকবে।

জেরেমি হান্টের মতে, যুক্তরাজ্যে অবশ্যই কর ও খরচের সীমা বাড়ানো উচিত। এতে করে বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে আসবে এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে। তাঁর এসব পদক্ষেপের পর পাউন্ডের দাম ২ দশমিক ৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। অবশ্য কোয়ার্টাঙের পদত্যাগের পর থেকেই এই দাম বাড়ছিল।

লুইস থমসন বলেন, হান্টের সোমবারের ঘোষণা এটাই বোঝায় যে লিজ ট্রাসের পরিকল্পনাগুলো ভুল ছিল। এর জেরে কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি যেসব আর্থিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা–ও ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হন। হান্ট অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর এমন একটি অবস্থা দেখা দেয়, যে মনে হচ্ছিল তাঁর ছড়ির ইশারায় ঘুরছেন ট্রাস।

বিষয়টি নিয়ে গত কয়েক দিন ওয়েস্টমিনস্টার ঘিরেও কম গুজব ছড়ায়নি। অনেকে এটাও মনে করছিলেন, ট্রাসের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটের আয়োজন করা হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন জেরেমি হান্ট।

এমন কিছু অবশ্য হয়নি। লিজ ট্রাস নিজেই পদত্যাগ করেছেন। তাঁর ক্ষমতায় থাকা অল্প কয়েক দিনে যুক্তরাজ্যের তেমন একটা ক্ষতি হয়নি। তবে বড় ক্ষতি হয়েছে ট্রাসের জনপ্রিয়তার। থমসনের কথায়, ‘ছয় সপ্তাহ আগে একজন আইপ্রণেতা হিসেবে লিজ ট্রাসের বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশের হাল ধরতে কিছুই করতে পারেননি। তাঁর নেতৃত্বে করজারভেটিভ পার্টি আরও টালমাটাল মনে হয়েছে। আর বরিস জনসনের সময় দলটি থেকে মানুষ যত দূরে সরে গিয়েছিল, এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।’

এগিয়ে লেবার পার্টি

লিজ ট্রাসের পদত্যাগে কনজারভেটিভ পার্টির প্রতি যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে খুব একটা পরিবর্তন আসবে না বলে মনে করছেন লুইস থমসন। তিনি বলেন, ‘জরিপে দেখা গেছে, কনজারভেটিভদের চেয়ে লেবার পার্টি বহু এগিয়ে আছে। তাই এখন আগাম নির্বাচন কনজারভেটিভদের জন্য চরম ঝুঁকির হতে পারে।

ফলাফলও হতে পারে তাদের জন্য বিপর্যয়ের। তাই দলটির আইনপ্রণেতারা চাইবেন সরকার চালিয়ে যেতে। তবে দিন যতই গড়াচ্ছে, যুক্তরাজ্যে কনজারভেটিভদের ধসে পড়ার সম্ভাবনাও বাড়ছে।’

সাম্প্রতিক একটি জরিপে দেখা গেছে, জনপ্রিয়তায় কনজারভেটিভদের চেয়ে ১৭ শতাংশ এগিয়ে লেবার পার্টি। ২০০১ সালে যখন টনি ব্লেয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তারপর থেকে এত জনপ্রিয়তা পায়নি লেবার পার্টি। অধ্যাপক নিকোলাস অ্যালেনের ভাষায়, লিজ ট্রাসের পদত্যাগের পর কনজারভেটিভ পার্টি এখন অথৈ সাগরে পড়েছে।

সর্বশেষ