নির্বাচন নিয়ে কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ, সরকার বাঁকা চোখে দেখছে

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশিত: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০৯
...
দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব নির্বাচন বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের আগে সবসময়ই বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্র এবং উন্নয়ন সংস্থার ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকরা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিজেদের আশাবাদের কথা ব্যক্ত করার পাশাপাশি এসব লক্ষ্য অর্জনে
নানান পরামর্শও দিয়ে থাকেন। সব সরকারের আমলেই চাপে থাকা বিরোধী দলগুলো সেসব বক্তব্য-পরামর্শকে স্বাগত জানান। কিন্তু, লক্ষণীয় যে এবার জাতীয় নির্বাচনের প্রায় বছর দুয়েক আগে থেকেই বিদেশি কূটনীতিকরা নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে আসছেন।

এছাড়াও বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, এবার নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের কয়েক মাস আগে থেকেই ইসি গঠন এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে নিজেদের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করে আসছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকরা। চলতি বছরের ২৬শে ফেব্রুয়ারি নতুন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তার মাত্র কয়েক দিন আগে (২২শে ফ্রেব্রুয়ারি) পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন কূটনীতিকদের সীমা লঙ্ঘন না করার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, ‘পরামর্শ গ্রহণযোগ্য, তবে শিষ্টাচার না মানা হলে সতর্ক করা হবে। আমরা কখনোই চাইবো না আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের কোনো রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ থাকুক। আমাদের সকলকে আরও সংযত হওয়া দরকার, যাতে করে আমাদের নিজেদের সমস্যাগুলো আমরা নিজেরাই সমাধান করতে পারি।’ কূটনীতিকরা সীমা লঙ্ঘন করলে সাবধান করা হবে জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘তারা আমাদের উন্নয়ন সহযোগী। তাই তাদের আগ্রহ থাকতে পারে। কিন্তু, আগ্রহ থাকা আর লেকচার দেয়া আলাদা জিনিস। তারা যদি কোনো রকম সীমা লঙ্ঘন করে অবশ্যই আমরা তাদের সাবধান করে দেবো।’

শুধু পররাষ্ট্র সচিবই নন, বিভিন্ন সময়ে সরকারের উচ্চপদে দায়িত্বশীল অনেকের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও প্রকাশ্যে কড়া ভাষায় বিদেশি কূটনীতিকদের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন।

২০২০ সালের শুরুতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণে বিদেশি কূটনীতিকদের ‘কোড অব কন্ডাক্ট’- মেনে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন তো বিদেশি কূটনীতিকদের বাংলাদেশ ছাড়ার হুমকিও দিয়েছিলেন! নির্বাচন ঘিরে বিদেশি কূটনীতিকদের বৃটিশ হাইকমিশনে মিলিত হওয়ার বিষয়য়ে আপত্তি তুলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘কূটনীতিকরা নিজেদের কাজ বাদ দিয়ে আমাদের ডমেস্টিক (অভ্যন্তরীণ) ইস্যুতে নাক গলাচ্ছেন। এটা উচিত নয়। ডিপ্লোম্যাটরা কোড অব কন্ডাক্ট মেনে কাজ করবেন। আর যারা মানবেন না, তাদের বলবো- দেশ থেকে চলে যান।’

দু’-এক মাস আগেও (১৪ই জুলাই) আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল- আলম হানিফ বলেছেন, ‘দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়ে যে কোনো সমস্যা আমরা নিজেরাই বসে সমাধান করতে পারি। আর যদি তা না পারি, তবে কোনো বিদেশি এসে তা সমাধান করতে পারবে না। বিদেশিদের কাছে ধরনা দেওয়া রাজনৈতিক দৈন্যতার বহিঃপ্রকাশ।’ এ সবের জবাবে বিএনপি সহ বিরোধী দলগুলোর নেতারা বলেন, অতীতে বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগের নেতারাও বিদেশিদের আনুকূল্য চেয়েছেন, সাহায্য প্রার্থনা করছেন। এ সবের মধ্যেই ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে’, পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের এমন বক্তব্যে সরকারকে ঘায়েল করার একেবারে মোক্ষম অস্ত্র পেয়ে যায় সরকার বিরোধীরা।

ওদিকে, নির্বাচন নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে বক্তব্য দিয়েই যাচ্ছেন বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকরা। তারা বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, ‘স্বাগতিক দেশের রাজনৈতিক দলসমূহ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা কূটনীতিকদের মূল কাজ।’ গত ২৪শে জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়েনের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি, জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্রোস্টার, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত অ্যান ভ্যান লিউয়েন সহ ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কূটনীতিক বৈঠক শেষে এমন বার্তা দিয়ে জানান, কূটনীতিকরা স্বাগতিক দেশের পরিস্থিতি এবং উন্নয়ন সম্পর্কে গভীর ধারণা পেতে যতটা সম্ভব অংশীদারদের সঙ্গে দেখা করতে চান এবং এর প্রয়োজন আছে।
নির্বাচনের এখনো অনেক দিন বাকি থাকলেও ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়’- জানিয়ে দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ঢাকায় দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে অনেকবারই বলেছেন, ‘নির্বাচন কার্যত ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে’। তার মতে, ‘আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান কেবল নির্বাচনের দিন ভোটদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।’ রাষ্ট্রদূত হাস ইতিমধ্যেই (৮ই জুন) নির্বাচন কমিশনে গিয়ে সিইসি’র সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পশ্চিমা দূতদের পাশাপাশি তাদের মিত্রদেশগুলোর দূতরাও কমিশনে গিয়েছেন। ২৯শে আগস্ট জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি সিইসি’র সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে ‘আগামী সাধারণ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে’- এই আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমি সিইসি’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। নির্বাচনের প্রস্তুতি কেমন তা জানার জন্য। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তিনি কী প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সেটা আলোচনা করেছি।’

নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতি ও রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক সময়ে কূটনীতিকদের সবচেয়ে বেশি দৌড়ঝাঁপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজপথের মূল বিরোধী দল বিএনপির নেতাদের পাশাপাশি সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সঙ্গেও সম্প্রতি অনেক দেশের রাষ্ট্রদূত সাক্ষাৎ করেছেন।

গত ১৭ই সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকার বনানীতে বিএনপি’র এক কর্মসূচি শেষে ফেরার পথে হামলায় আহত হন বিএনপি’র অনেক কেন্দ্রীয় নেতা। পরদিন সকালেই জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি দূতাবাসের পলিটিক্যাল অফিসার ইয়োশাইকি কোবাইশিকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে যান। ৩১শে জুলাই ভোলায় পুলিশের গুলিতে বিএনপি’র দুই নেতা নিহত হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জে ১লা সেপ্টেম্বর পুলিশের গুলিতে আরেকজন নিহত হন। এর এক সপ্তাহ পর (৭ই সেপ্টেম্বর) বৃটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন এবং হাইকমিশনের পলিটিক্যাল কাউন্সিলর টম বার্জের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপি নেতারা বৈঠকে বসেন। সেখানে সাম্প্রতিক সহিংসতা এবং বিএনপি নেতাকর্মীদের মৃত্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

তার ঠিক পরদিন ৮ই সেপ্টেম্বর জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান এবং সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদেরের সঙ্গে তার বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করেন অস্ট্রেলিয়ার ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নারদিয়া সিম্পসন। এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দলটি জানিয়েছে- বৈঠকে সামাজিক, অর্থনৈতিকের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। সপ্তাহখানেক পর ১৫ই সেপ্টেম্বর জিএম কাদেরের বাসভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্রোস্টার। দলটি জানায়, বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।

ওদিকে, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের নতুন হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা ইতিমধ্যেই ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন। ঢাকায় নিজ দায়িত্ব পালনের শেষদিন বিদায়ী হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ‘নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির পাশে নয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত সব সময় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে’ মন্তব্য করে বলেন, ‘আমরা সব সময় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছি, বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি।’

সর্বশেষ

সর্বশেষ