নাসায় বাংলাদেশি মহাকাশ বিজ্ঞানীদের পদচারণা

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশিত: ২ আগস্ট ২০২২, ১২:০৮
...
নাসায় বাংলাদেশি মহাকাশ বিজ্ঞানীদের পদচারণা
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার
সৌরজগতের বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে মানুষের জল্পনাকল্পনার সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর ঘাঁটি হচ্ছে নাসা (ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন)। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্বাধীন সংস্থা, যা বিমানচালনাবিদ্যা ও সৌরজগৎ সম্পর্কিত গবেষণা করে থাকে। আর গবেষণার খোরাক জোগাতে নাসা তার প্রতিষ্ঠা সাল ১৯৫৮ থেকেই একের পর এক শক্তিশালী ও দ্রুতগতির টেলিস্কোপ পাঠাচ্ছে মহাকাশে। এসব টেলিস্কোপ প্রতিনিয়ত মহাকাশের এমন সব তথ্য ও ছবি প্রেরণ করেছে, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গবেষণাকে আরও বেগবান করতে উৎসাহিত করছে, উদ্বুদ্ধ করছে আরও শক্তিশালী নভোযান তৈরি ও প্রেরণ করতে। যদিও ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-১ মহাকাশে পাঠিয়েছিল। নাসার সাফল্যের অব্যাহত ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল টেলিস্কোপ ‘হাবল’ পাঠায় মহাকাশে এবং এটি গত তিন দশক অত্যন্ত সফলভাবে কাজ করে মহাবিশ্ব সম্পর্কে জ্যোতির্বিদদের ধারণা একেবারে পালটে দিয়েছে। পরিষ্কার ও উজ্জ্বল দৃশ্য দেখার ক্ষমতা (০.০৫ আর্কসেকেন্ড) এবং মহাবিশ্বের ‘লার্জ ম্যাজেলানিক ক্লাউড’ এলাকার ‘ট্যারানচুলা নীহারিকা’ এবং পৃথিবী থেকে সাড়ে ছয় হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত ‘কারিনা নীহারিকা’র ছবি তুলতে হাবল ছিল খুবই দক্ষ।


কিন্তু মহাজগতের আরও অনেক দূরের এবং লাখো কোটি বছর আগে সৃষ্ট বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য হাবলের চেয়েও বহুগুণ শক্তিশালী নভোযান জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি) উৎক্ষেপণ করা হয় ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর। উৎক্ষেপণের ৩০ দিনের মাথায় এটি ১৫ লাখ কিলোমিটার মহাকাশ পথ পাড়ি দিয়ে তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে। অতঃপর নিজেকে গুছিয়ে কার্যক্রম শুরু করতে সময় নিয়েছে আরও ছয় মাস। ফলে কার্যত ২০২২ সালের জুলাই থেকে যন্ত্রটি পৃথিবীতে বৈজ্ঞানিক উপাত্ত প্রেরণ করতে শুরু করেছে। এর পাঠানো মহাকাশের দুর্দান্ত রঙিন ছবি দেখে সম্প্রতি চোখ জুড়িয়েছে বিশ্ববাসীর। এমনকি নাসাও এই প্রথম পূর্ণাঙ্গ রঙিন ছবি প্রকাশ করতে দ্বিধা করেনি। কারণ ছবিগুলোর বিশেষত্ব হলো, এগুলো ৪৬০ কোটি বছর পূর্বের মহাবিশ্বের ছায়াপথগুচ্ছের ছবি। মহাকাশের রঙিন ছবিগুলো জেডব্লিউএসটির প্রথম ‘ফুল-কালার ডিপ ফিল্ড ইমেজ’। একই সঙ্গে মানবজাতির ইতিহাসে দূর মহাবিশ্বের ‘ডিপেস্ট’ (গভীরতম) ও ‘শার্পেস্ট’ (সুস্পষ্ট) ইনফ্রারেড ছবি। অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটি উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল, তার সফলতা এখন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের হাতের মুঠোয়। প্রাপ্ত তথ্য ও ছবি নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ ও গবেষণা। আর এ গবেষণায় কাজ করছেন বিভিন্ন দেশের এক হাজার জনেরও বেশি জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তাদের মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী লামীয়া আশরাফ মওলা। কানাডার ১৫ সদস্যের দলে তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি, যিনি পেশায় একজন অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট। লামীয়া ২০২০ সালে ফেলো হিসাবে কানাডার ডানল্যাপ ইনস্টিটিউট ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের সঙ্গে যুক্ত হন এবং জেডব্লিউএসটিতে কানাডিয়ান দলে গ্যালাক্সির পাইপলাইন নিয়ে বিশ্লেষণ ও গবেষণা করছেন।

প্রকৃতপক্ষে নাসার সঙ্গে বাংলাদেশের জ্ঞানীদের ঘনিষ্ঠতা বহু আগে থেকেই। বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ১৯৮২-তে পাশ করা বাংলাদেশি বিজ্ঞানী আতিকুজ জামান এখন পর্যন্ত নাসার সঙ্গে কাজ করছেন মহাশূন্যের সঙ্গে ইন্টারনেট কমিউনিকেশন নিয়ে। তিনি কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। সম্প্রতি নাসার গবেষণা দল ইটা কারিনার মতো আরাধ্য পাঁচটি বিশাল নক্ষত্র খুঁজে পেয়েছেন, যা অবস্থান করছে মিল্কিওয়ের বাইরের গ্যালাক্সিগুলোয়। আর সেই গবেষণা দলের (মেরিল্যান্ডের গডার্ড স্পেস ফ্লাইট) নেতৃত্বে ছিলেন এবং এখনো আছেন বাংলাদেশের ছেলে ড. রুবাব ইমরাজ খান। ২০০৪ সালে তিনি অ্যাস্ট্রোফিজিকসে পড়াশোনার জন্য কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে বৃত্তি পান। ২০০৮ সালে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে ২০১৪ সালে ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেন। এদিকে নাসার সেরা উদ্ভাবনী পুরস্কার-২০১৭ জিতে নাসার বিজ্ঞানীদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মাহমুদা সুলতানা। মহাকাশে সহজে ব্যবহার করা যাবে, এমন ছোট ও যুগান্তকারী প্রযুক্তি যন্ত্র আবিষ্কারের জন্যই এ পুরস্কার দেওয়া হয়। ন্যানো টেকনোলজি, থ্রিডি প্রিন্টিং, ডিটেক্টর ডেভেলপমেন্ট নিয়েই মাহমুদার গবেষণা। এমআইটিতে কোয়ান্টাম ডট প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন আলো তরঙ্গ ডিটেক্টর নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি। এখানে পিএইচডি চলাকালীন তার বানানো সেন্সর প্ল্যাটফরম নিয়ে এক জব ফেয়ারে তিনি নাসায় কাজের সুযোগ পান ২০১০ সালে।

এদিকে নাসার মিশন কন্ট্রোল সেন্টারে (এমসিসি) সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসাবে কাজ করছেন সিলেটের মাহজাবীন। মিশিগানের ওয়েইন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন তিনি। উল্লেখ্য, এ এমসিসি থেকেই নাসার রকেট উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আবার নাসায় আবহাওয়া বিজ্ঞানী হিসাবে কাজ করছেন সুনামগঞ্জের ড. ফাহাদ আল আবদুল্লাহ। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করে ফাহাদ নাসার গ্লোবাল মডেল অ্যান্ড স্যাটেলাইট ডেটা অ্যাসিমিলেশন অফিসে কাজ শুরু করবেন। নীলফামারীর ছেলে এরশাদ কবির চয়ন (২৯) নাসার আরলিংটন ভার্জিনিয়ায় তথ্য প্রকৌশলী (ডেটা ইঞ্জিনিয়ার) হিসাবে চাকরি করছেন। তিনি ২০২০ সালে বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে তথ্যবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এখানেই শেষ নয়; ‘পৃথিবী থেকে ২০২৫ সালে প্রথমবারের মতো মঙ্গল গ্রহে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য নির্বাচিত সেরা চারজন সৌভাগ্যবান মানব-মানবীর মধ্যে বাংলাদেশি নারী মহাকাশচারী বিজ্ঞানী লুলু ফেরদৌস (৩৫) একজন। তিনি বর্তমানে নাসাতে সহযোগী গবেষক হিসাবে কর্মরত আছেন।

বর্তমান তরুণ প্রজন্ম মহাকাশ ও নভোমণ্ডল নিয়ে খুবই আগ্রহী। তারা মহাকাশ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন ডেটা নিয়ে বিশ্লেষণ করছে, তৈরি করছে নানা অ্যাপস ও টুলস। সম্প্রতি নাসা অ্যাপস চ্যালেঞ্জ-২০২১ প্রতিযোগিতায় খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) এবং বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বাউয়েট)-এর সম্মিলিত ‘টিম মহাকাশ’ বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব অর্জন করেছে। বিশ্বের ১৬২টি দেশের ৪ হাজার ৫৩৪টি দলকে হারিয়েছে তারা। মহাকাশচারীরা ভিনগ্রহের পৃষ্ঠে অভিযানের সময় মুক্তভাবে উড়তে থাকা ধূলিকণার মধ্যে কাজ করতে সমস্যার সম্মুখীন হন। একই সঙ্গে মহাজাগতিক রেডিয়েশনের কারণে আয়নিত হওয়ায় তা স্পেসস্যুটের গায়ে লেগে স্যুট ড্যামেজ হয়ে যায়। ‘টিম মহাকাশ’ এ সমস্যার সমাধানে একটি টুলসেট উদ্ভাবন করে, যেটি এ ধূলিকণাগুলোকে আবদ্ধ চেম্বারে আটকে ফেলে এবং ধূলিকণাগুলোকে ভেসে থাকার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে দেয় না। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালেও বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। বাংলাদেশি এ তরুণ প্রজন্মই ভবিষ্যতে নাসা থেকে সৌরমণ্ডলে উড্ডয়ন করবে, সোনার বাংলার পতাকা রাখবে মহাকাশে।

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ