'তুই তুকারি' বাংলা স্টাইল এবং হিরো আলমদের মান ইজ্জত

যুক্তরাজ্য থেকে ডাঃ আলী জাহান
প্রকাশিত: ২ আগস্ট ২০২২, ১১:০৮
...

১. ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রথম তলায় উত্তর দক্ষিণ বরাবর আউটডোরের দিকে যাবার যে লম্বা করিডোর আছে তা দিয়ে আমি যখন নিউরোলজি ডিপার্টমেন্টের দিকে যেতাম তখন প্রায়ই দেয়ালে একটি লেখা চোখে পড়তো। অনেকদিন পরে সেই লেখাটি আমার চোখের সামনে আবার ভেসে উঠছে। ওই লেখাটি এখন আর আছে কিনা জানি না। দেয়ালে লেখা খুবই সাধারণ একটি কথা। কিন্তু এর মর্মার্থ অনেক। বিনিময়ও অনেক বেশি।

২. ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিঁড়ির ওপরে দেয়ালে সে লেখাটি নিয়ে কথা বলার আগে আমাদের আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমের ঘটনা বর্ণনা করা দরকার।

৩. বগুড়ার ছেলে হিরো আলমকে নিয়ে ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ এবং পরবর্তীতে অতি প্রভাবশালী এক  পুলিশ কর্মকর্তার সাংবাদিক সম্মেলনে 'তুই এবং সে'র প্রয়োগ অনেককে ভাবিয়ে তুলেছে। রাজনৈতিকভাবে প্রচণ্ড শক্তিশালী একজন পুলিশ কর্মকর্তার হিরো আলমকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলা কোন ভদ্রতার পর্যায়ে পড়ে? 'সে এটা বলেছে, সে এটা করেছে, সে এটা জানে না' না বলে ওই কর্মকর্তা যদি 'তিনি এটা বলেছেন, তিনি এটা করেছেন, তিনি এটা জানেন না' বলতেন তাহলে তাঁর কোন ক্ষতি হতো না। আপনার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ কিছুটা হলেও হয়তো বাড়তো। প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কি আসলেই মানুষের মতামতের পরোয়া করেন? আপনি কি আসলেই মনে করেন যে যাদেরকে 'তুই, তুকারি' করছেন ওদের ট্যাক্সের টাকায় আপনার জীবন চলে, চেহারায় জৌলুস আসে, দামি গাড়ি হাঁকান, কানাডা-আমেরিকায় বাড়ি বানান? আপনি কীভাবে একটি সংবাদ সম্মেলনে হিরো আলমকে নিয়ে এভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলতে পারলেন?

৪. হিরো আলমকে ডিবি পুলিশের অফিসে যে ভাষায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তা কি ভদ্র মানুষের ভাষা হতে পারে? ' তুই নামের আগে হিরো লাগাস কেন? তোর চেহারা কি হিরোর মত? তুই কি কখনো আয়নায় তোর চেহারা দেখেছিস?' এমন প্রশ্ন করা কোন ভদ্রতার পর্যায়ে পড়ে তা আমার জানা নেই।

৫. হিরো আলম বয়সে আপনার অনেক ছোট হতে পারেন। ব্যক্তিগত পর্যায় আপনি তাকে হয়তো তুমি বলতে পারেন।কিন্তু সরকারি চেয়ারে বসে আপনি যখন তাঁর সাথে কথা বলবেন, তাঁকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করবেন, তখন তাকে আপনি করেই সম্মোধন করবেন।

কারণ, হিরো আলম এ দেশের একজন নাগরিক। তিনি গান-বাজনা করেন, মাঝেমধ্যে অদ্ভুত পোশাক পরেন, সিনেমা বানান, এবং একবার এমপি পদে নির্বাচনও করেছেন।তাঁর একটি বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে। হাসাহাসি করার জন্য বা নিছক বিনোদনের জন্য কেউ কেউ হয়তো তাকে ফলো করেন। আবার অনেকেই তাকে ভালোবেসে ফলো করেন।ইউটিউব এবং ফেসবুকে তাঁর ভিডিওগুলোর ভিউ দেখলেই তা বুঝতে পারবেন। সেই হিরো আলমকে সরকারি চেয়ারে বসে তুই তুকারি করার কোন অধিকার  আপনার নেই। হিরো আলম সাহেব গান করতে পারেন কিনা, তাঁর অভিনয় ভালো কিনা, তিনি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারেন কিনা- এ বিষয়ে দেশের যেকোনো নাগরিক প্রশ্ন তুলতেই পারেন। পুলিশের কাছে যে কেউ অভিযোগ করতে পারেন। অভিযোগ পেলে পুলিশ ডেকে নিয়ে হিরো আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই পারেন।কিন্তু  তাঁর প্রতি পুলিশের প্রয়োগ করা ভাষা? 'তুই, সে'!'তুই কিসের হিরো? কখনো তুই আয়নায় তোর চেহারা দেখেছিস?'


৬. আমি ভাবছি ক্ষমতার বাইরে থাকা মানুষদের কীভাবে অপদস্ত করে কথা বলতে হয় এ বিষয়ে কি কোন সরকারি ট্রেনিং আছে? থাকার কথা নয়। তবে পুলিশ সহ কিছু অতি উৎসাহী সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের এমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ভাষা ব্যবহারের একটি বৈজ্ঞানিক কারণ আছে। এবং সে কারণটি হচ্ছে মানুষের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় তা নিয়ে কোন ট্রেনিং প্রদান না করা। ফলে দেখে দেখেই উনারা শিখেন।উনারা উনাদের সিনিয়রদের ভাষা প্রয়োগ দেখেন। রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের মুখে  প্রায় প্রতিদিনই অন্যকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে করে কথা বলা শুনেন। আর সেগুলো শুনতে শুনতে কখন যে এই ভয়াবহ অভ্যাস তাদের ভেতর চলে এসেছে তা তারা বুঝতে পারেন না। হিরো আলম তাদের সেই মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন!

৭. যে দেশের সরকারি বা রাজনৈতিক কর্তাদের মুখে অন্য দলের নেতা-নেত্রীদের নিয়ে 'সে জনগণের টাকা চুরি করেছে, সে এখন কারাগারে আছে, সে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছে, সে কখনো জেল থেকে বের হতে পারবে না'  এমন বক্তব্য প্রতিদিন আসে, সে দেশে পুলিশ কর্মকর্তারা হিরো আলমের মতো নিরীহ বালককে ' তুই তুকারি' করে কথা বলবেন এটাই স্বাভাবিক।  সেখানে হিরো আলম সাহেবের কপাল ভালো যে, তিনি শুধু ভাষা সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ‘অন্য কিছুর’  শিকার হননি।

৮. তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে অধীনস্থদের তুই তুকারি করা কি বাংলাদেশে কিছু মানুষের অভ্যাস ও ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে? শুধুমাত্র কি বাংলা ভাষায় এই অদ্ভুত নিয়মটি চালু আছে? 'আপনি তুমি এবং সে'। কপাল ভালো যে ইংরেজিতে এই বর্ণবাদী নিয়মটি নেই। আপনি, তুমি এবং তুই- আলাদা করার প্রয়োজন নেই। রাজা প্রজা সবাই He/she and YOU. সে কারণেই হয়তো ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা।

৯. আপনি হয়তো বাংলা ভাষার পরিবর্তন করতে পারবেন না। তবে সাধারণ মানুষের সাথে 'তুই তুকারি না আপনি তুমি'  ব্যবহার করবেন তা আপনার একান্ত  ব্যক্তিগত শিক্ষা ও রুচির ব্যাপার। আপনার ভাষার প্রয়োগ দেখে সাধারণ মানুষ আপনার ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে একটি ধারণা  নিতেই পারেন। অজান্তেই আপনি আপনার ভেতরের খারাপ মানুষটির পরিচয়টি প্রকাশ করে দিচ্ছেন।

১০. ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফিরে আসি।হাসপাতালের করিডোরে লেখা সেই বাক্যটি ছিল ' মানুষের সাথে সৌজন্য দেখাতে কোন খরচ হয় না, কিন্তু বিনিময়ে পাওয়া যায় অনেক'। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দেয়ালে লেখা এই বাণীটি গণভবন, সংসদ ভবন, সচিবালয়, সরকারি অফিস, আদালতপাড়া এবং পুলিশ ভবনের দেয়ালে টাঙ্গানোর সময় চলে এসেছে। বলা যায় না তুই তুকারি করে কথা বলার আগে এ দেয়াল লিখন চোখ পড়লে শব্দগুলো 'তুই, সে' থেকে 'আপনি, তিনি' হয়েও যেতে পারে।


ডা: আলী জাহান

কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, UK

সাবেক পুলিশ সার্জন, UK

alijahanbd@gmail.com

সর্বশেষ