শ্রীলঙ্কার পরিণতির জন্য আমলাতন্ত্রের দায়ও কম নয়

পি কে বালাচন্দ্রান
প্রকাশিত: ১৩ জুলাই ২০২২, ১৩:০৭
...

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনগণের মধ্যে গভীরভাবে গেড়ে বসা একটি ধারণা হচ্ছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বই সুশাসন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। এখন যেমন শ্রীলঙ্কার বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের বদল হলেই জাদুর মতোই বর্তমান শাসনব্যবস্থার যে সংকট, সেটার অবসান হবে। এ কারণেই শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে দিয়ে সর্বদলীয় সরকারের দাবি জোরেশোরেই উচ্চারিত হচ্ছে।

এটা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই যে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক নেতৃত্ব চলমান সংকটের জন্য অনেকাংশে দায়ী। আবার এটাও সত্য যে দ্বীপরাষ্ট্রটির আমলাতন্ত্র তাদের দিক থেকে যে ভূমিকা পালন করার কথা ছিল, সেটা পালন করেনি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সঠিক পথে যাতে থাকে, সে জন্য যে দিকনির্দেশনা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা দেয়নি।

এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সামন্তীয় মূল্যবোধ থেকে জন্ম নেওয়া প্রভু–ভৃত্যের সম্পর্ক, অনুপযোগী ও সেকেলে নিয়োগপদ্ধতি, প্রয়োজনীয় দক্ষতার ঘাটতি অথবা

দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ না থাকা। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কাজের মূল্যায়নের জন্য যথাযথ কোনো পদ্ধতি নেই শ্রীলঙ্কায়। পরিণতি কী হবে—এমন ভয়ে তাঁরা কখনো সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এর বদলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলার কৌশল তাঁরা নেন। ঘটনা পরিক্রমায় আইন হয়তো মন্ত্রীকে ধরতে পারে, কিন্তু এর প্রথম শিকার হন নিচু স্তরের সরকারি কর্মচারী।

সাউথ–ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোহাম্মদ ইব্রাহিম মোহাম্মদ ইরফান শ্রীলঙ্কার আমলাতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর মতে, শ্রীলঙ্কার সরকারি কর্মচারীদের ঘাড়ে বিশাল দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসন চালানোর দায়িত্বও তাঁদের দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লোকশ্রুতি হচ্ছে শ্রীলঙ্কার আমলাতন্ত্র অকার্যকর। কোনো কাজে কতটা দেরি করানো যায় এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে মিলে কীভাবে দুর্নীতি করা যায়, তা নিয়েই তাঁরা ব্যস্ত থাকেন। সামগ্রিকভাবে শ্রীলঙ্কার আমলাতন্ত্রের মান খুব নিচু স্তরের।

অন্য দুই গবেষক হাসনা মুনাস ও নিসান ডি মেলের গবেষণায় শ্রীলঙ্কার আমলাতন্ত্র নিয়ে বেশ মূল্যবান ধারণা পাওয়া যায়। গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে তাঁরা কৃষিকে বেছে নেন। শ্রীলঙ্কার মোট জনসংখ্যা ২০ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত। রপ্তানি আয়ের ২৩ শতাংশ আসে কৃষি থেকে। কিন্তু এ খাতের মানুষের কাছে পৌঁছানো তথ্যের মাত্র ৪০ শতাংশ সঠিক এবং ২০ শতাংশ তথ্যই সেকেলে। গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে, ব্যবসা পরিচালনাসংক্রান্ত তথ্য কৃষকদের কাছে না পৌঁছানোটাই শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ একটি অন্তরায়।

এটা নিশ্চিতভাবে শ্রীলঙ্কার আমলাতন্ত্রের ব্যর্থতারই একটি নজির। দুজন গবেষক বলেছেন, ‘শ্রীলঙ্কার আমলাতন্ত্রের এই বাজে দশা, আমাদের ধারণার চেয়েও গুরুতর সমস্যা তৈরি করছে। শ্রীলঙ্কা এখন ঠিক করতে পারেনি আমলাতন্ত্রকে কীভাবে জবাবদিহির মধ্যে আনা যাবে।’
গবেষণায় তাঁরা দেখিয়েছেন, যুগের পর যুগ ধরে কৃষি শ্রীলঙ্কার রাজনীতিবিদদের কাছে মৌখিকভাবে গুরুত্ব পেয়ে আসছে। তা সত্ত্বেও অর্থনীতিতে কৃষির অবদান বাড়েনি, বরং ক্রমাগত কমেছে। শ্রীলঙ্কার জিডিপিতে কৃষির অবদান বহু বছর ধরে ৮ শতাংশের নিচে স্থির হয়ে আছে। কৃষিতে রপ্তানি আয় ২০১১ থেকে ২০১৬–এর মধ্যে ৪ শতাংশ কমে গেছে।

শ্রীলঙ্কায় আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে যে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা, তা পুরোটাই বিশৃঙ্খলায় ভরা। আমদানি–রপ্তানি পরিচালনা ও তদারকির জন্য ২১টি প্রধান সরকারি সংস্থা ও ২৩টি আইন রয়েছে। প্রতিটি আইনের আওতায় আবার বেশ কটি বিধিমালা রয়েছে। আবার প্রতিটি সংস্থা পরিচালনার জন্য আলাদা আইন ও বিধিমালা রয়েছে। ফলে সময়মতো সঠিক তথ্য খুঁজে বের করা ভীষণ কঠিন একটা ব্যাপার। এটাই শ্রীলঙ্কায় ব্যবসা করার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়।

ব্যবসা পরিচালনার এই জটিল ব্যবস্থা দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের দুর্নীতি করার সুযোগ করে দেয়। ঘুষ ছাড়া তাঁরা সঠিক তথ্য দেন না। অনেক মন্ত্রণালয়ই তাদের ওয়েবসাইটে ঠিকমতো তথ্য দেয় না অথবা আধেয়গুলো হালনাগাদ করে না। এ ক্ষেত্রে ওয়েবসাইটে সঠিক ও হালনাগাদ তথ্য দেওয়ার কি কোনো বিকল্প আছে?
২০০৭ সালে শ্রীলঙ্কার শুল্ক কর্তৃপক্ষ ইউএসএআইডির সহযোগিতায় একটি শুল্ক সম্পর্কিত তথ্যভান্ডার গড়ে তুলেছিল, যাতে শুল্ক আইন, পরিচালনার বিধিমালা ও পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া ছিল। কিন্তু সেটা রক্ষণাবেক্ষণ ও তথ্য হালনাগাদ করার কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। এ অবস্থার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আমলাতন্ত্র—দুই পক্ষই সমান দায়ী।

শ্রীলঙ্কার যদি সদিচ্ছা থাকে, তাহলে তারা সিঙ্গাপুরের কাছ থেকে শিখতে পারে। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে কার্যকর দেশ সিঙ্গাপুর। সেখানে বিশ্বের সেরা প্রশাসনিক কাঠামো ও সংস্কৃতি রয়েছে। ছোট্ট দেশ সিঙ্গাপুরে আমলাতন্ত্রের আকার বিশাল। ১৬টি সরকারি বিভাগ এবং ৬০টির বেশি বিধিবদ্ধ সংস্থায় প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার সরকারি কর্মচারী রয়েছেন। কিন্তু সেটা কোনোভাবেই শ্বেতহস্তীতে পরিণত হয়নি।

দ্য মিরর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

পি কে বালাচন্দ্রান শ্রীলঙ্কায় কর্মরত ভারতীয় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

প্রথম আলো

সর্বশেষ