মুসলমানের সবচেয়ে বড় শত্রু কারা?

মওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান, তর্জমা: আহনাফ তাহমিদ
প্রকাশিত: ১ জুন ২০২২, ১২:০৬
...

ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা প্রসঙ্গে কুরআনে এরশাদ আছে: আজ কাফেররা তোমাদের দীনের প্রতি হতাশ হয়ে গেছে। তাদেরকে আর ভয় পাবার কিছু নেই। তোমরা কেবল আমার ভয়েই ভীত হও৷ (সুরা মায়েদা : আয়াত ৩)।

এ আয়াত দশম হিজরিতে বিদায় হজের সময় নাজিল হয়। এর দেড় মাস পরে আল্লাহর রাসুল (সা.) আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন। সেই হিসেবে আয়াতটির মর্মার্থ হচ্ছে: আল্লাহর রসুল ও সাহাবায়ে কেরামের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ইসলামের ইতিহাস এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে— যাকে বলা যায় আপন শক্তিতে বলীয়ান। ইসলাম বাহির থেকে আসা আক্রমণ থেকে নিরাপদ হয়ে গেছে, এখন যদি কোনো আশঙ্কা থেকেও থাকে, তা ভেতর থেকে আসতে পারে, বাহির থেকে নয়।

উল্লিখিত আয়াতে এ মর্মে আল্লাহর স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি আছে যে, মুসলমানদের ওপর বহির্শত্রু বিজয় লাভ করবে— এমন কোনো ভয় নেই। তবে মুসলমানদের চিন্তার বিষয় একটাই, সেটা হলো তাদের মধ্যে খোদাভীতির অনুপস্থিতি। আল্লাহকে ভুলে তারা বিপথে চালিত হবে, এটাই মূলত আশঙ্কার ব্যাপার।

এই আশঙ্কা কাল্পনিক নয়, ইতিহাস এর সাক্ষী। মুসলমানদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ অসীম। তাদেরকে তিনি সুবিস্তৃত ভূমির অধিকার দিয়েছেন। তাদের জনশক্তি এত বিপুল করেছেন যে, জনশক্তির অভাবে তারা পরাস্ত হবে বা শত্রুর মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হবে— এমন আশঙ্কার কোনো কারণ নাই। তাদের সামনে অর্থনৈতিক উন্নতির সম্ভাবনা আছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি তাদের হাতে রয়েছে। সব ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ প্রতিনিয়ত তাদের ঘরে জন্ম নিচ্ছে।

তাদের আছে এমন এক মহান ঐশীগ্রন্থ, যা জ্ঞানতাত্ত্বিক জগতে তাদের দিতে পারে অনন্য অবস্থান। তাদের আছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস। কেয়ামত পর্যন্ত যা প্রতিটি প্রজন্মকে দেখাবে আশার আলো, সাহস যোগাবে, তাদের মধ্যে তৈরি করবে উদ্দীপনা আর উচ্ছ্বাস।

যে জাতির কাছে উন্নতি-অগ্রগতির এত সব উপাদান রয়েছে, বাহিরের কোনো জাতির তাদেরকে পরাধীন করার দুঃসাহসও দেখাতে পারবে না। একমাত্র আহাম্মকিই তাদের ওপর বয়ে আনতে পারে লাঞ্ছনা আর অপদস্থতা। তাদেরকে করে দিতে পারে দুর্বল। আহাম্মকি মূলত  অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর মতবিরোধ থেকে আসে।

মানুষের মনে যতক্ষণ খোদাভীতি জাগরূক থাকে,  ততক্ষণ তারা পরস্পরের কল্যাণকামী থাকে, ইনসাফের সঙ্গে অন্যের হক আদায় করে, সমগ্র জাতি তখন হিংসা-বিদ্বেষের নাপাকি থেকে পবিত্র থাকে। এমন পরিবেশে তখন সবখানেই কেবল  ঐক্য আর ঐক্যের দেখা পাওয়া যায়।

কিন্তু যদি উল্টোটা ঘটে— মানুষ যখন আল্লাহকে ভুলে যায়, খোদাভীতি লোপ পায় তাদের অন্তর থেকে, তখন সবাই পরস্পরের ক্ষতিসাধনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সবাই স্বার্থের পেছনে অন্ধের মতো দৌড়াতে থাকে। পরশ্রীকাতরতা, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধপরায়ণতা সমগ্র জাতিকে গ্রাস করে ফেলে।

খোদাভীতি ঐক্যের পথ তৈরি করে। আর ঐক্যই হলো সবচেয়ে বড়ো শক্তি। আর আল্লাহর ভয় মন থেকে উবে যাওয়া মাত্রই অনৈক্য সৃষ্টি হয়। আর পারস্পরিক সংঘাতের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো দুর্বল হয়ে পড়া— তা সে যত বড় জনগোষ্ঠীই হোক,  সংখ্যাধিক্য তখন কোনো কাজেই আসে না।

দুজন মুসলিম মিলে একটা কাজ শুরু করল। কোনো কারণে কিছুদিন পর তাদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হলো। এখন তারা যদি মিটমাট করে যে যার রাস্তা ধরে, বাকি কাজ-কারবার আগের মতোই জারি রাখে, তাহলে তাদের দ্বারা সমাজের কোনো ক্ষতি বা কমজোরির আশঙ্কা করা যায় না।

কিন্তু যদি এমন না হয়— তারা বিরোধটাকে দীর্ঘ করে এবং বিরোধের জের ধরে একে-অপরকে শায়েস্তা করতে উঠে-পড়ে নামে, তাহলে তাদের আশপাশের লোকেরা এতে আক্রান্ত হবে। সামাজিক শক্তি-শৃঙখলা দুর্বল হয়ে পড়বে।
 

একজন মুসলিম অপর মুসলিমের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার পর কোনো কারণে তার প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করতে হয়। এখন যদি প্রস্তাবদাতা এর অন্যরকম অর্থ না করে অন্যকোথাও পাত্র তালাশ করে, তাহলে সমাজে কোনোরকম বিরূপ প্রভাব পড়বে না৷ 
পক্ষান্তরে তার মনে যদি প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে, তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা চালায়, তাহলে আল্লাহই জানে কত বছর কত যুগ ওই দুই পরিবারের মধ্যে বিরোধ চলতে থাকবে! আর এসবের প্রভাব কি দুটো পরিবার পর্যন্তই সীমিত থাকে? অবশ্যই না। গোটা সমাজ এর বিষবাষ্পে আক্রান্ত হয়।

এক মুসলিম অপর মুসলিম থেকে একটা ভবন ভাড়া নিল। কোনো কারণে লোকটার ওপর ভবন-মালিকের অভিযোগ দেখা দিল। এখন যদি মালিক সমস্য সমাধানের পথ খুঁজেন, তাহলে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট হবার সম্ভাবনা নেই। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ঐক্যও থাকবে সুপ্রতিষ্ঠিত।

পক্ষান্তরে মালিক যদি সুষ্ঠু সমাধানের পথে না গিয়ে ভাড়াটেকে উৎখাত করতে উঠে-পড়ে লাগে, তার নামে কুৎসা রটায়, নিচু করতে চেষ্টা করে, কীভাবে লোকটার বিনাশ ঘটানো যায় সেই ধান্ধা করে— তাহলে তা উম্মতের দুর্গে ফাটল ধরানোর মতোই গর্হিত কাজ হবে। এর ফলাফল কী হবে জানেন? একদল ভাড়াটের পক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে, আরেকদল মালিকের। উম্মত দুটো ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়বে। যে শক্তি-সক্ষমতা তাদেরকে উন্নতি ও সংহতি উপহার দিতে পারত, এখন তাই হবে ডেকে আনবে বরবাদি, বিনাশ ও ধ্বংস।

আমাদের সামনে বেশ কিছু প্রোজ্জ্বল উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত রয়েছে। আমরা দেখতে পাই সংঘবদ্ধতার পথ অবলম্বনের মাধ্যমে কীভাবে উম্মাহর সন্তানেরা শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠতে পারে।

আবার কিছু উদাহরণ থেকে এও উপলব্ধি হয় যে, সংঘবদ্ধতা আর ঐক্যের অভাব কীভাবে তাদের ধ্বংসের মুখে এনে ফেলে; নিজেকে তো বটেই, গোটা সমাজটাকেই অস্থিতিশীল আর দুর্বল করে তোলে। শেষবিচারের কথা বেমালুম ভুলে যাওয়ার কারণেই আমাদের মধ্যে এত দ্বন্দ্ব-ফাসাদ। মানুষের মাঝে সত্যাসত্যই যদি খোদাভীতি থাকে, তাহলে সে মুখ দিয়ে এমন শব্দ উচ্চারণ করবে না, যা আল্লাহর কাছে তার ব্যক্তিত্বকে খাটো করে; যা আল্লাহকে নারাজ করবে।

তেমনই সে এমন সব কাজ এড়িয়ে চলবে যা রোজ কেয়ামতে আল্লাহর কাঠগড়ায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করবে৷ আল্লাহর ভয়ে ভীত সকলেই নিজের দোষ স্বীকার করে, অন্যকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকে।যে সমাজের এমন চিত্র দেখা যাবে, সেখানে অবশ্যই ঐক্য বিরাজমান থাকবে। আর ঐক্যের অপর নামই শক্তি।মানুষ অন্যের জন্য কূপ খনন করে। সে ভুলে যায় নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই পড়তে পারে। ভুলে যায় যেকোনো সময় আসতে পারে মৃত্যুর থাবা।

এক থাবায় দুনিয়া থেকে উঠিয়ে তাকে পরকালে নিয়ে যাওয়া হবে; জবাবদিহি করতে হবে পরাক্রমশালী রবের কাছে, তাকে প্রশ্ন করা হবে আল্লাহর দেওয়া জান-মাল ও আমানত কীভাবে খরচ করেছে; তার বান্দাদের ক্ষতি সাধন করার জন্য কোন অধিকারে সে আল্লাহর নেয়ামতকে ক্ষয় করেছে! এর সবই মানুষ বেমালুম ভুলে আছে!আসলে মানুষ যদি মৃত্যুর বাস্তবতা চিন্তা করত, শিক্ষা নিত এ থেকে, তাহলে আত্মশুদ্ধির জন্য তা-ই যথেষ্ট ছিল!

সর্বশেষ