টাঙ্গাইলের নাগরপুর জমিদার বাড়ি: প্রত্যাশা ছিলো কলকাতার আদলে এক নগর গড়ার


প্রকাশিত: ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০২:১১
...
বোহেমিয়ান ফয়সাল: নাগরপুর জমিদার বাড়ি বলতে আমি যা জেনেছি বা যা শুনেছি তা হলো নাগরপুর মহিলা কলেজের আওতায় দু’তিনটি ভবন আছে শুধু, আর কিছুই নেই। যাই হোক কলেজের ভিতর নাকি প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু আমাদের সাথে পরিচিত কয়েকজন স্থানীয় তুষার ভাইর পরিচিত বন্ধুরা যোগ দেওয়ায় আমাদের জন্য বড় একটা সুযোগ তৈরি হলো। স্থানীয় থাকার কারনে ভিতরে ঢুকতে কোন রকম কোন ঝামেলা হয় নেই, জমিদার বাড়ির মূল রাজভবনটি বর্তমানে মহিলা কলেজের আওতায় এখন এবং এর পাশেই আরো ২টি পুরাতন ভবন আছে, একটা হলো জমিদার বাড়ির জলসা ঘর। যেই জলসা ঘরের জৌলুশ এখনো পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাইনি। সুউচ্চ জলসা ঘরটি প্রমাণ করে এই জমিদার বাড়ির জৌলুশ কতদূর ছিলো। কত উচ্চ পর্যায়ের ছিলো এদের আকাঙ্খা, কত বাইজি নেচেছে এখানে তার কোন হয়তো হিসেব নেই।

এই জমিদার বাড়িটি একটি বিশাল এলাকাজুড়ে অবস্থিত (প্রায় ৫৪ একর)। জমিদার যদুনাথ চৌধুরী ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। যদিও আমি এই তিনটি ভবন বাদে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু জমিদার বাড়ির বিশাল এরিয়া যে কলেজের পিছনের অংশে তখনও আমার তা অজানা।
ঊনবিংশ শতাব্দীর কথা তখন ব্রিটিশদের শাসন চলছে ভারতীয় উপমহাদেশে, ইতিহাস থেকে যতটুকু তথ্য পাওয়া যায় তা হলো- সুবিদ্ধা খাঁ’র সূত্র ধরেই চৌধুরী বংশ নাগরপুরে জমিদারী শুরু করেন। চৌধুরী বংশের প্রথম পুরুষ যদুনাথ চৌধুরী। তাদের বংশক্রমে দেখা যায়- এমন তার তিন ছেলে যথাক্রমে উপেন্দ্র মোহন চৌধুরী, জগদীন্দ্র মোহন চৌধুরী ও শশাঙ্ক মোহন চৌধুরী।

নাগরপুরের পূর্ব দিকে ধলেশ্বরী এবং পশ্চিম পাশ ঘেষে আছে যমুনা নদী। এক সময় এই যমুনা নদীর মাধ্যমে নাগরপুর এলাকার সাথে সরাসরি কলকাতার ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল। এই বাড়ির সাথে ‘কলকাতা’র নাম স্মরণীয়। যাইহোক নদী তীরবর্তী এলাকা হওয়ার কারনে এখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা।

বিশাল এই জমিদার বাড়ীতে যা দেখছি, তা দেখে নিজেই তাজ্জব হয়ে গেছি। কলেজ থেকে বের হয়েই পাশের গলিতে ঢুকে পরলাম, আর এ গলিতেই রয়েছে রাজবাড়ীর আরো ১০/১২টি ভবন যার ৬/৭টি ভবন অনেক বড় ৩/৪ তলা করে এবং প্রায় ভবনেই মানুষ বাস করে। রাস্তা দিয়ে ঢুকলেই সামনে পরবে একটা পরিত্যক্ত মন্দির ঘর, এরপাশে রয়েছে আরো একটি পরিত্যক্ত ঘর।

এই জমিদার বাড়িতে ঢুকার সময় আমি এই বাড়ি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। বৃটিশ সরকার উপেন্দ্র মোহন চৌধুরীর বড় ছেলে সতীশ চন্দ্র রায় চৌধুরীকে সাধারণ জনগোষ্ঠীর জন্যে বিভিন্ন সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘রায় বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করে। তিনি যখন রায় বাহাদুর খেতাবে ভূষিত হন তখন তিনি এই নাগরপুরকে কলকাতার মত একটা নগর অর্থাৎ আরেকটি ‘কলকাতা’ করতে চাচ্ছিলনে। পুরো নাগরপুরকে সাজাতে চেয়েছিলনে কলকাতা’র আদলে।

এক সময়ের আধুনিক এক নগর ‘নাগরপুর নগর’ যা আজ ভৌতিক এক নগরে রূপান্তরিত হয়েছে। দেশভাগের করুণ পরিনাম এই নাগরপুর। ফুটবল জগতে কলকাতার ইষ্ট বেঙ্গলের নাম কে না জানে। সেই ইস্ট বেঙ্গলের সাথে এই পরিবারের সম্পর্ক ছিলো খুবই ঘনিষ্ট।

উপেন্দ্র মোহন চৌধুরী’র ছোট ছেলে মানে সতীশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর ভাই অপেক্ষাকৃত পাশ্চাত্য সংস্কৃতিঘেষা। তিনি ছিলেন অনেকের চেয়ে সৌখিন প্রকৃতির মানুষ, ছিলেন খুব ক্রীড়ামোদী। তিনিই ছিলেন ইষ্ট বেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী।

বর্তমানে এই জমিদার বাড়ির কোনটা কি ভবন ছিলো তা বলা দায়, এখন প্রায় ভবন দখলদারদের কবলে চলে গেছে। যেসব ভবন দখলদারদের কবলে যায়নি তারা তাদের ভগ্ন দেহের ধ্বংসের দিনক্ষণ গুনছে নিয়মিত। পাশ্চত্য এবং মোঘল সংস্কৃতির মিশ্রনে এক অপূর্ব নান্দনিক সৌন্দর্যে নির্মিত এই বৈঠকখানা বিল্ডিং এর উপরে ছিল নহবতখানা।

যারা এই বাড়িতে বসবাস করে তারা স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এখানে বসবাস করেন। তিনতলা দুটি ভবনের ছাদ থেকে আশপাশের সবগুলো ভবন দেখা যায়। বাহ কি দারুণ এক নগর ছিলো। ব্রিটিশ এবং মোঘল স্থাপত্য মিশেলে এসব বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছিলো। যেনো কলকাতার স্বাদ প্রত্যেকটা বাড়িতে নিহিত রয়েছে, কিন্তু কে রাখে কার খোঁজ? আজ যে- সবই দখল হয়ে গেছে।

চৌধূরী বাড়ীর অন্যান্য স্থাপনার মধ্যে ঝুলন দালান অন্যততম। প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন শিল্প কর্মে মন্ডিত চৌধুরী বংশের নিত্যদিনের পূজা অনুষ্ঠান হত এই ঝুলন দালানে। বিশেষ করে বছরে শ্রাবনের জ্যোৎস্না তিথিতে সেখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের নাটক, যাত্রা মঞ্চায়িত হতো। এখানেই চৌধুরী বংশের শেষ প্রতিনিধি মিলন দেবী (মিলন কর্ত্রী) স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে চৌধুরীদের উপাসনা বিগ্রহ ‘বৃন্দাবন বিগ্রহ’-এর নিরাপত্তা দিতে গিয়ে দুষ্কৃতকারীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।

ছাদগুলো এখনো এই নাগরপুর জমিদার বাড়ির ইতিহাসের স্বাক্ষী দিচ্ছে, আমরা যে দুটো বাড়ির ছাদে উঠেছি সে বাড়ি দুটো ছোট একটি উঠোনকে কেন্দ্র করে চারপাশে সুউচ্চ তিনতলা বিল্ডিং। আমরা এখানে যেসব বাড়ির নাম জানতে পেরেছি এবং যেসব বাড়ি দেখতে পেয়েছি তা হলো-
ঝুলন্ত দালান, ঘোড়ার দালান, রং মহল, পরীর দালান ও বাঘের দালান।

দূর থেকে দেখলে কয়েকটি ভবনের জানালাগুলো দেখে মনে হয় যেন অনেক আগেই ভবনগুলো পরাজয় বরণ করে নিয়েছে। অথচ এখানেই এক সময় জমিদার এবং তার পরিবার বসবাস করতেন। তখন হয়তো ভবনগুলোর চাকচিক্য দেখে মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো। কিন্তু এখন এই ভবনগুলো জৌলুস হারিয়ে শুধুমাত্র ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে, আর নির্জীবতাকে সঙ্গী করে বিলীন হওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
বি.দ্র: তবে কারো কারো মতে যদুনাথ চৌধুরীরা কেউ জমিদার ছিলেন না। তবে চৌধুরী উপাধিতে ভূষিত খানদানী ব্যবসায়ী ছিলেন। অর্থাৎ এটা জমিদার বাড়ি নয়, চৌধুরী বাড়ি। সূত্র: ফেসবুক, আমাদের টাঙ্গাইল

সর্বশেষ