জেদের নাম রাজনীতি নয়

আনিসুল হক
প্রকাশিত: ৮ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:১২
...
পলিটিকস ইজ দ্য আর্ট অব কম্প্রোমাইজ। রাজনীতি হলো মীমাংসার ক্ষেত্র। আপসহীনতার জায়গা রাজনীতি নয়। ধরা যাক, একটা দুই লেনের রাস্তায় দুটি গাড়ি আসছে বিপরীত দিক থেকে। দুটি গাড়ি মাঝখানের দাগের ওপরে আছে। তার কোনোটি সরছে না। এ অবস্থায় হয় গাড়ি দুটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে, না হয় হবে অচলাবস্থা। অনেক সময় নিজের শক্তি সম্পর্কে উচ্চ ধারণা থাকে। অনেক সময় জিদের কারণে, রোখের কারণে বাস্তববুদ্ধি ও সুবিবেচনা কাজ করে না। একটি গাড়ি ভাবতে পারে, আমি তো পাঁচ টনি ট্রাক, আমি কেন সরব, অপর পারে ছোট গাড়ি, ওকেই সরতে হবে। কিন্তু তাতে যদি বড় গাড়ির ধাক্কায় ছোট গাড়ির ক্ষতি হয়, সেটির যাত্রীদের ক্ষতি হয়, তার ধকল উভয় পক্ষকেই চিরকাল পোহাতে হবে। কেউই আসলে জয়লাভ করবে না। এতে রাস্তা বন্ধ হবে, বহু মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কষ্ট পাবে।

রাজনীতি তো কেবল দুটি গাড়ির যাত্রীর ব্যাপার নয়। এটা হলো ১৭ কোটি মানুষের ভালো থাকা, খারাপ থাকার ব্যাপার। এর সঙ্গে এখনকার মানুষের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভালো থাকা, মন্দ থাকা জড়িত। এটা জিদের ব্যাপার নয়। আত্মসম্মানের ব্যাপার নয়।

১০ ডিসেম্বর বিএনপির প্রস্তাবিত সমাবেশের স্থান নিয়ে আজ পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে, তার সবটাই চরম অনাকাঙ্ক্ষিত, পরম আতঙ্কজনক। এর মূলে আছে পারস্পরিক অবিশ্বাস। সরকার হয়তো ভাবছে, বিএনপি কেন নয়াপল্টন ছাড়তে চায় না, তাদের কোনো সুদূরপ্রসারী অভিসন্ধি আছে। বিএনপি ভাবছে, ওরা কেন আমাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঠেলতে চায়, ওদের কোনো মতলব আছে। এ নিয়ে উভয় পক্ষ দেশের মানুষকে ভয়াবহ উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দিতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে হানাহানি হয়েছে। একজন মানুষ মারা গেছে। অনেকেই আহত। অনেকে আটক। অনেকে বাড়িছাড়া। যে মানুষটা মারা গেছেন, মকবুল আহমেদ, তাঁর স্বজনেরা জানেনও না, তিনি নয়াপল্টনে যাবেন। তিনি দল করেন না। সমর্থন করেন বিএনপিকে। তিনি কোন ফাঁকে এই হানাহানির শিকার হলেন, স্বজনেরা বুঝে উঠতে পারছেন না।

এখন তাঁর সন্তান মিথিলা নামের শিশু বাবার জন্য অপেক্ষা করছে। বাবা আর ফিরবেন না। একজন মানুষের মৃত্যুও অনেক বড় ক্ষতি। অপূরণীয় ক্ষতি। সেই যে আলেক্সান্ডারকে দার্শনিক জেনোসিস বলেছিলেন, ‘আমাকে রোদ থেকে বঞ্চিত করো না, যা তুমি নিজে দিতে পারো না, তা তুমি কেড়ে নিতে পারো না।’ মানুষের জীবন আমরা দিতে পারি না, তাই তা আমরা কেড়ে নিতেও পারি না।

নেলসন ম্যান্ডেলা আজ সারা বিশ্বে স্মরণীয়, বরণীয়। আমরা তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারি। তিনি যে দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ শাসনের অবসান ঘটাতে পেরেছিলেন, তা সম্ভব হয়েছিল এ জন্য যে তিনি সাহস করে আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে আগে গিয়েছিলেন। পরে তিনি বলেছেন, এতে অনেক ঝুঁকি ছিল, কিন্তু তাকে সমঝোতার উদ্যোগের এই ঝুঁকি নিতে হয়েছিল, এটাই তাঁর সাহসিকতার প্রমাণ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জিতেও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা বন্ধ করেননি ১৯৭১ সালের মার্চেও। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সেই ভালো সেনাপতি, যে বিনা রক্তপাতে যুদ্ধ জিততে পারে।

আমরা চাই সরকারের দিক থেকে আলোচনা-মীমাংসার উদ্যোগ নেওয়া হোক। সংঘাত কারও জন্য ভালো হবে না। জিদ করা সন্তানের সাজে, গৃহকর্তার সাজে না। নাগরিকসমাজ থেকেও কাউকে মধ্যস্থতার জন্য ডাকা যেতে পারে। ১০ ডিসেম্বর ২০২২ দেশে সংঘাতের রাজনীতি শুরু হয়ে যাক, এটা আমরা কেউ চাই না। দেশের মানুষ চায় না। দেশের মানুষ শান্তি চায়।

আমাদের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমবেত হওয়ার অধিকার, বিক্ষোভ প্রকাশের অধিকার রক্ষা করতে হবে। এটাই এখন ন্যূনতম গণতন্ত্রের সূচক।

বিএনপিকেও বুঝতে হবে, জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতির দিন শেষ। মানুষের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু সম্পদ হয়েছে, ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়, বাবা-মা তাদের নিয়ে আশা দেখেন। এখন কেউ নিজের জীবনের ও পরিবারের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে দিতে রাজি নয়। আর দেশের মানুষ উভয়ের শাসন দেখেছে। বিএনপির ভোটার আছে, কিন্তু বিএনপিও কোনো আশাবাদী ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনার কথা বলছে না। কাজেই যা করার, সমঝোতার মাধ্যমে, না হলে অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে করতে হবে। একজনেরও মৃত্যু হতে পারে, এমন সহিংস আন্দোলন দেশে-বিদেশে কারও কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।

আবারও বলি, সমঝোতার পথই শ্রেষ্ঠ পথ। কথা বলুন। সংঘাত পরিহার করুন। বিএনপিকে ছাড় দিতে হবে। সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সবার ওপরে দেশ। সবার ওপরে মানুষ। মারো রে, কাটো রে, এটা কোনো পলিসি হতেই পারে না। শান্তির ডাক দিন, সংঘাতের নয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন, জ্বালাময়ী কথা বলে মানুষকে আতঙ্কিত করবেন না।

১০ ডিসেম্বর বরং সূচনা করুক সমঝোতা, মীমাংসা ও সহাবস্থানের নতুন শান্তিময় দিগন্ত।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক
প্রথম আলো

সর্বশেষ