যুক্তরাষ্ট্রের চিপস এবং সায়েন্স অ্যাক্ট ও বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ

মাসুদ আল আজিজ
প্রকাশিত: ৮ নভেম্বর ২০২২, ১৬:১১
...

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাস হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত ‘চিপস অ্যান্ড সায়েন্স অ্যাক্ট।’ যেখানে ‘৯০ এর দশকে আমেরিকা তার প্রয়োজনের ৩৭% চিপ নিজ দেশেই তৈরি করতো, এখন সেটা ১২% এ নেমে এসেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্বব্যাপী চিপের দুষ্প্রাপ্যতা, জাতীয় নিরাপত্তা এবং চীনের সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে বৈরিতা। এই চিপস অ্যান্ড সাইন্স অ্যাক্ট’ এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে আমেরিকার হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনা, কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান তৈরি করা। 

এই আইনের আওতায় আগামী পাঁচ বছরে মোট বিনিয়োগ করা হবে প্রায় ২৫০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি যার মধ্যে প্রায় ১৭০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হবে ‘রিসার্চ এবং ইনোভেশনে’ এবং ২৪ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে নতুন উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোকে ট্যাক্স ক্রেডিটের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রণোদনা দিতে। যাই হোক, এই লেখার উদ্দেশ্য নতুন এই আইনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে তৈরি হওয়া সুযোগ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উচ্চ শিক্ষার্থীরা কীভাবে গ্রহণ করতে পারে, সেই বিষয়ে আলোচনা করা।   

মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় ইলেক্ট্রনিক্সের বদৌলতে আমরা সবাই কমবেশি সেমিকন্ডাক্টর চিপ, আইসি বা ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট এসব নামের সঙ্গে পরিচিত। এসব ইলেকট্রনিক্স লক্ষ লক্ষ ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট সমন্বয়ে তৈরি হয় এবং এদের সবার বিল্ডিং ব্লক হচ্ছে ট্রানজিস্টর। কিছু কিছু কোম্পানি আছে যারা শুধু ট্রানজিস্টর উৎপাদন করে এবং সেগুলো বিক্রি করে- এদের বলে ফাউন্ডরি, যেমন তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কর্পোরেশন, ইউনাইটেড মাইক্রোইলেকট্রনিক্স কর্পোরেশন, গ্লোবাল ফাউন্ড্রিজ ইত্যাদি। আবার কিছু কোম্পানি আছে যারা ট্রানজিস্টর ফাউন্ডরির কাছ থেকে কিনে নেয় এবং তারপর সেগুলো ব্যবহার করে আইসি ডিজাইন করে, এদেরকে বলা হয় ফ্যাবলেস সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি, যেমন কোয়ালকম, এনভিডিয়া, ব্রডকম ইত্যাদি। যারা দুটো ব্যবসাই করে, তাদের বলে ইন্টিগ্রেটেড ডিভাইস ম্যানুফ্যাকচারার, যেমন স্যামসাং ইলেকট্রনিক্স,  ইন্টেল কর্পোরেশন, টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্ট ইত্যাদি ।

৯০’র দশকের শুরুতে এই ফাউন্ডরি ব্যবসার মূল কেন্দ্র ছিল জাপানে, এনইসি কর্পোরেশন, তোশিবা কর্পোরেশন এদের হাতে যা পরে দখল করে নেয় মার্কিন কোম্পানি ইন্টেল, এএমডি (বর্তমানে গ্লোবাল ফাউন্ড্রিজ) । কিন্তু গত এক দশকে এশিয়ান কোম্পানিগুলোর উত্থানে উল্লেখযোগ্য ব্যবসা চলে যায় স্যামসাং (দক্ষিণ কোরিয়া), ইউনাইটেড মাইক্রোইলেকট্রনিক্স কর্পোরেশন (তাইওয়ান), তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কর্পোরেশন (তাইওয়ান), উইন সেমিকন্ডাক্টর (তাইওয়ান), সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন (চীন) এদের হাতে। মূলত এখানে দুটি বিষয় আমেরিকার মাথাব্যথার কারণ। এক, চীনের সঙ্গে বৈরিতা এবং জাতীয় নিরাপত্তাজনিত কারণে চাইনিজ ফাউন্ডরি থেকে ট্রানজিস্টর কিনতে মার্কিন কোম্পানিদের নিরুৎসাহিত করা । দুই, তাইওয়ানের সঙ্গে চীনের বৈরিতা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো চীন যদি তাইওয়ানকে আক্রমণ করে বসে, তখন চীনের সরবরাহের ওপর পুরোপুরি নির্ভর না হয়ে যাওয়া।    

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার ঘোষণায় বলেন এই ‘চিপস অ্যান্ড সায়েন্স অ্যাক্ট’ এর আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে ফাউন্ডরি ব্যবসার প্রচুর বিনিয়োগ হবে এবং ফলশ্রুতিতে আনুমানিক তিন লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ইন্টেল এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে তারা আমেরিকার ওহাইও অঙ্গরাজ্যে ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে চিপ প্ল্যান্ট গড়ে তুলবে যেখানে ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। মাইক্রন টেকনোলজি প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে যা প্রায় ৪০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করবে। এ ছাড়া কোয়ালকম এবং গ্লোবাল ফাউন্ড্রিজ যৌথ পার্টনারশিপের মাধ্যমে ৮.২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে নিউ ইয়র্কে তাদের চিপ প্ল্যান্টের সম্প্রসারণের কাজে। 

একথা সর্বজনবিদীত যে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে যার কারণে আমাদের মতো লক্ষ লক্ষ অভিবাসীরা এখানে কর্মরত আছি। অদূর ভবিষ্যতে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হলে দক্ষ অভিবাসীদের চাহিদা আরও বাড়বে। তাই যে সমস্ত বাংলাদেশিরা বিদেশে ক্যারিয়ার গড়তে চান, তারা যদি এখন থেকে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন, তবে ভবিষ্যতে সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি পাওয়া অনেক সহজ হবে। 

এখানে উল্লেখ্য যে, প্রচলিত ধারণা হলো সেমিকন্ডাক্টর বা ফাউন্ডরিগুলোতে শুধু তড়িৎ প্রকৌশলীদের চাহিদা থাকে যদিও ব্যাপারটা পুরোপুরি সত্য না। এটা ঠিক যে, তড়িৎ প্রকৌশীলের সংখ্যা বেশি থাকে কিন্তু একটি ফাউন্ডরিতে অনেক ধরনের বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয়। যেমন ধরা যাক, কোয়ালিটি ইঞ্জিনিয়ার বা রিলিয়াবিলিটি ইঞ্জিনিয়ার পদবীতে গণিত বা পরিসংখ্যান থেকে পাস করা বহু মানুষ কর্মরত আছেন। 

আবার প্যাকেজ ইঞ্জিনিয়ার পজিশনে প্রচুর যন্ত্রপ্রকৌশলীরা চাকরিরত আছেন। এ ছাড়া প্রচুরসংখ্যক পদার্থবিদতো আছেনই। তাছাড়া ইলেকট্রনিক ভেহিকেলের জন্য ব্যাটারির ওপর প্রচুর কর্মসংস্থানও তৈরি হচ্ছে যেখানে রসায়ন থেকে পাস করা মানুষদের জন্য প্রচুর সুযোগ রয়েছে। আবার এত নতুন প্ল্যান্ট গড়ে তোলার জন্য প্রচুর কনস্ট্রাকশনের প্রয়োজন হবে যেখানে পুরকৌশল প্রকৌশলীদের প্রয়োজন হবে। তাই কোন বিষয় থেকে পাস করে আসছেন, সেটা অত গুরুত্বপূর্ণ না; গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই বিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকা অথবা অধ্যনরত ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তদ্রুপ কোর্স করে আসা। পরিকল্পিত উপায়ে প্রস্তুতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে এই সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে ক্যারিয়ার গড়ে তোলা খুব একটা কঠিন হবে না।      

লেখক: পিএইচডি, কোয়ালকমে কর্মরত, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

সর্বশেষ