ইতালিতে কট্টর ডানপন্থীদের বিজয়ে উদ্বেগ প্রবাসী বাংলাদেশিদের

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশিত: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৬:০৯
...

ইতালির নির্বাচনে কট্টর ডানপন্থী জর্জা মেলোনি জয় পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন। এর ফলে তিনি এখন দেশটির ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। জর্জা মেলোনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালির সবচেয়ে কট্টর সরকারের নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে ইতালির সম্ভাব্য সে পরিবর্তনের প্রভাব হয়তো দেখা যাবে গোটা মহাদেশের ওপর। তবে নির্বাচনের পর মোলোনি বলেছেন, তার দল 'ব্রাদার্স অব ইতালি' সবার জন্য কাজ করবে। মানুষের ভরসার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।

নির্বাচনে দলটির প্রধান ইস্যু ছিল অভিবাসন এবং অবৈধ অভিবাসন ঠেকানো। এজন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা। মিজ মেলোনির জোটের অন্যান্য শরিক দলগুলোও অভিবাসন কমানো এবং দেশটির ওপর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রভাব কমানোর দাবি তুলেছে।

ইউরোপে ঢোকার জন্য প্রতিবছর ভূমধ্যসাগর হয়ে এবং স্থলপথেও প্রচুর মানুষ ইতালিতে যান। এদের মধ্যে প্রচুর বাংলাদেশিও রয়েছেন। অভিবাসী বাংলাদেশিরা বলছেন, এই মুহূর্তে দেশটিতে বৈধভাবে কাজ করছেন এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি। এখনও কাজকর্ম এবং চাকরির বৈধ কাগজপত্র নেই কিংবা হওয়ার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এমন বাংলাদেশির সংখ্যাও ৫০ হাজারের বেশি।

রাজধানী রোম এবং ভেনিসে কাজ করছেন এমন কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে এক ধরণের চাপা উদ্বেগ কাজ করছে। যারা ইতোমধ্যেই কাজ ও বসবাসের বৈধ কাগজপত্র পেয়েছেন তাদের মধ্যে অবশ্য উদ্বেগ কিছুটা কম। কিন্তু যারা এখনও স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাননি তাদের আশঙ্কা, নতুন সরকার অভিবাসন নীতি কঠোর করলে তাদের বৈধতা পেতে সমস্যা হবে। এছাড়া মুসলমান বিরোধী মনোভাবের শিকার হতে পারেন এমন আশঙ্কাও রয়েছে অনেকের মনে।

ইতালির বাংলাদেশ সমিতির সাবেক সভাপতি নুর আলম সিদ্দিকী বাচ্চু অবশ্য মনে করেন, অভিবাসীদের প্রতি যত কঠোরই হোক, হয়তো তাদের সরাসরি দেশে ফেরত পাঠাবে না এই সরকার। কিন্তু নানা নিয়মকানুন করে হয়তো তাদের চাপে রাখা হবে।

নুর আলম সিদ্দিকীর আশঙ্কা, নতুন সরকার হয়তো অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে আইন করবে এবং তাদের অভিবাসীবিরোধী প্রচারণা যেভাবে চালাবে তাতে সমাজে 'বিদেশি বনাম ইতালিয়ান' একটি দূরত্ব তৈরি হবে। তার ভাষায়, ‘যেহেতু এদেশে বেকারত্ব এবং অপরাধের পেছনে ইমিগ্রেন্টদের কারণ বলে মনে করা হয়, সে কারণে নতুন সরকার এসে অনিয়মিত অভিবাসী শ্রমিক এবং অপরাধ ঠেকাতে বিধিনিষেধ দেবে। এরপর টার্গেট দেবে, যে বিদেশি ১০ বছর ১৫ বছর কাজ করছে, তারে ফেরত পাঠাও।’

অভিবাসীরা নানা হয়রানির শিকার হবেন এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে প্রচার চালিয়ে রেখে হয়তো কোণঠাসা করে রাখা হবে। যাতে বেতনের ব্যাপারে আমরা মাথাচাড়া না দেই। আমাদের কায়িক শ্রমকে অল্প পয়সায় নেওয়ার জন্য আমাদের মানসিক চাপে রাখা হবে। হয়তো দেখা যাবে, ডকুমেন্ট রিনিউ হচ্ছে না। এমন নানা কিছু।’

নুর আলম সিদ্দিকী মনে করেন, এসব চাপের কারণে নতুন অভিবাসীদের ইতালিতে নিরুৎসাহিত করা হবে। সমুদ্রপথে আসা অভিবাসীদের প্রবেশ মুখগুলোতে যেহেতু কড়াকড়ি হবে, সে কারণে ওই প্রবেশ মুখগুলোতে যখন রেডক্রসের মতো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করে, তাদের কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে। এর ফলে সমুদ্রপথে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে অভিবাসনেচ্ছু মানুষেরা দুর্ঘটনায় পড়লে তাদের প্রাণহানির ঝুঁকি বাড়বে।

চাপা উদ্বেগ বাংলাদেশিদের মধ্যে

ভেনিসের একটি আবাসিক হোটেলে কাজ করেন সাইমুন শরীফ জেসি। দুই বছর আগে ফ্যামিলি ভিসায় স্বামীর সঙ্গে গেছেন তিনি। কাজ করার জন্য 'টেম্পোরারি রেসিডেন্সি' পেয়েছেন কয়েক মাস আগে, যার মেয়াদ শেষ হবে ডিসেম্বরে। তিনি বলছেন, ফ্যামিলি ভিসায় আসার কারণে ইতালিতে তার অবস্থান নিয়ে হয়তো সরাসরি কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু তারপরও এক ধরণের চাপা উদ্বেগ রয়েছে মনে।

গত কয়েক বছর ধরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে এবং লিবিয়া হয়ে প্রচুর মানুষ অবৈধভাবে ইতালি ও গ্রিসে ঢুকেছে। এদের অনেকে ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে প্রবেশের উদ্দেশ্যে ইতালিকে একটি ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে। অবৈধভাবে প্রবেশ করে অনেকে কাজও করছিলেন দেশটিতে। কিন্তু সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘির উদ্যোগে নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে একটি নতুন আইন করা হয়। এর আওতায় অভিবাসীদের অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ ও বসবাসের অনুমতিপত্র, যাকে 'টেম্পোরারি রেসিডেন্সি' বলা হয়, দেওয়া শুরু হয়েছিল ২০২২ সালেই।

এই কর্মসূচির মাধ্যমে যেকোনও অভিবাসী ইতালির সংশ্লিষ্ট দফতরে এই 'টেম্পোরারি রেসিডেন্সি'র জন্য আবেদন করতে পারবেন। কোনও ব্যক্তিকে প্রথমবার এই অনুমতিপত্র দেওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি বা স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতির জন্য আবেদন করতে পারবেন।

ভেনিসের একটি আবাসিক হোটেলের মালিক আবেগ আল মামুন জানিয়েছেন, টেম্পোরারি রেসিডেন্সিতে সাধারণত প্রথমে ছয় মাসের অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর নিয়মিত বিরতিতে ওই অনুমতিপত্র নবায়ন করতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে নবায়নের সময় কর্তৃপক্ষ চাইলে অনুমতি নাও দিতে পারে। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হয়তো স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ ও নাগরিকত্ব পাবেন না একজন অভিবাসী।

বৈধ কাগজপত্র যাদের নেই তাদের শঙ্কা

গত ১৩ মাস ধরে রোমে রয়েছেন সামিউল ইসলাম। এটি তার ছদ্ম নাম। ইতালি পৌঁছে প্রায় সাত মাস বেকার থাকার পর এপ্রিলে তিনি অস্থায়ীভিত্তিতে কাজ ও বসবাসের অনুমতিপত্র নিয়ে রোমে কাজ করছেন। স্থায়ী পারমিট নেই বলে খুবই অল্প বেতনে কাজ করছেন তিনি। তার ভাষায়, ‘টেম্পোরারি রেসিডেন্সির কারণে মনে একটা আশা তৈরি হয়েছে যে, ঠিকমতো কাজ করলে এক সময় বৈধভাবে এখানে স্থায়ীভাবে থাকতে পারবো। কিন্তু এখন কী হবে বুঝতেছি না।’

নতুন সরকারের নীতির কারণে তার কাজের অনুমতিপত্র নবায়নে সমস্যা হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন। এদিকে, নতুন কট্টর ডানপন্থী সরকারের অভিবাসন নীতিমালার পাশাপাশি মুসলিমবিরোধী মনোভাব রয়েছে বলেও মনে করেন অনেকে। কারণ মিজ মেলোনি ইতোমধ্যেই একাধিকবার ইতালিতে মুসলিম অভিবাসীদের আগমনের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। চাকরি নিয়ে শঙ্কার পাশাপাশি সামিউল ইসলামের আরেকটি ভীতি হচ্ছে, মুসলমান হওয়ার কারণে তিনি কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হতে পারেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা।

সর্বশেষ

সর্বশেষ