সাগরে ইতিহাস সৃষ্টি করল ভারত

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশিত: ৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:০৯
...

বহু প্রতীক্ষার পর ভারতের সমুদ্রের জলে নামল আইএনএস বিক্রান্ত। এই যুদ্ধজাহাজ নিয়ে ভারত অনেক দিন ধরেই স্বপ্নের বীজ বুনছিল।তবে এবার স্বপ্ন সত্যি করে শুক্রবার সকালে কেরালার কোচিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে নৌসেনার হাতে দেওয়া হলো আইএনএস বিক্রান্তর দায়িত্ব। উদ্বোধন করা হলো ভারতের নৌবাহিনীর নতুন পতাকারও। আনন্দবাজার পত্রিকা।

শুক্রবার জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু হয় বিক্রান্তের যাত্রা। শুধু তাই নয়, ভারতের নৌবাহিনীকে এদিন নতুন পতাকা দেন মোদি; যা ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের সিলমোহর অর্থাৎ ‘রাজমুদ্রা’ থেকে নেওয়া হয়েছে।

শিবাজি মহারাজকে ভারতীয় নৌসেনার জনক হিসাবে মানা হয়ে থাকে। উদ্বোধনী বক্তব্যে মোদি বলেন, বিক্রান্ত শুধু একটি যুদ্ধজাহাজ নয়। এটি ২১ শতকের ভারতের কঠোর পরিশ্রম, প্রতিভা, প্রভাব ও প্রতিশ্র“তির প্রমাণ বলেও এদিন ব্যাখ্যা করেন প্রধানমন্ত্রী। তার মতে, এখন থেকে বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশগুলোর চোখে চোখ রেখে ভারত কথা বলতে পারবে।

নৌবাহিনীকে নয়া পতাকা দিয়ে মোদি বলেন, ব্রিটিশ গোলামি থেকে মুক্তি পেল ভারতের নৌবাহিনী। এতদিন ব্রিটিশ শাসনের চিহ্ন ছিল ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রতীকে। এবার থেকে তা সরে গেল।

আইএনএস বিক্রান্ত সম্পর্কে তিনি বলেন, বিক্রান্তে ব্যবহƒত তারগুলো কোচি থেকে কাশি পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। আইএনএস বিক্রান্ত দুটি ফুটবল মাঠের মতো বড়। এটি যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে তা পাঁচ হাজার ঘরকে আলোকিত করতে পারে।’ ভারতের জন্য আইএনএস বিক্রান্তের জলাবতরণ এক গর্বের বিষয়। কারণ এটিই ভারতে তৈরি প্রথম বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ। কিন্তু কেন এই যুদ্ধজাহাজকে নিয়ে এত উত্তেজনা তৈরি হয়েছে দেশবাসীর মনে? কী কী বিশেষত্ব রয়েছে এই যুদ্ধজাহাজের? সম্পূর্ণ ভারতীয় প্রযুক্তিবিদদের হাতে তৈরি হয়েছে বিক্রান্ত।

এর আগে বিদেশ থেকে কিনে আনা রণতরীই শত্র“পক্ষের ঝড়ঝাপটা সামলাত। এই প্রথম সম্পূর্ণভাবে দেশে তৈরি কোনো রণতরী নৌবাহিনীর শক্তি বাড়াতে ঢুকল। আইএনএস বিক্রান্তের দৈর্ঘ্য ২৬২ মিটার, অর্থাৎ ৮০ তলা একটি বাড়িকে যদি আড়াআড়ি শুইয়ে রাখা হয়, তা হলে প্রায় তার সমান।

এই জাহাজ ৬২ মিটার চওড়া এবং ৫৯ মিটার উঁচু। আইএনএস বিক্রান্তে ১,৭০০-এরও বেশি সেনা এবং কর্মকর্তার থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। সব মিলিয়ে ১৪টি ডেক রয়েছে এই জাহাজের। আর রয়েছে ২৩০০টি কামরা।

নারী কর্মকর্তাদেরও আলাদা করে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে এই বিশালাকায় রণতরীতে। উচ্চগতির জন্যও আলাদা করে নজর কাড়ছে বিক্রান্ত।

এই যুদ্ধজাহাজের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ২৮ নটিক্যাল মাইল (৫২ কিলোমিটার)। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজের গতিবেগের থেকে ঘণ্টায় ঠিক ৭ নটিক্যাল মাইল কম।

বারবার জ্বালানি ভরার দরকারও নেই বিক্রান্তে। একবার জ্বালানি ভরলেই অতিক্রম করতে পারবে সাড়ে সাত হাজার নটিক্যাল মাইল। অর্থাৎ একবারের জ্বালানিতে ভারতের নৌসীমা ধরে দু’বার অনায়াসে যাওয়া-আসা করা যাবে।

উন্নতমানের ইস্পাত দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিক্রান্তকে। এই যুদ্ধজাহাজ তৈরিতে যে ইস্পাত ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে অন্তত তিনটি আইফেল টাওয়ার তৈরি করে ফেলা যাবে। জাহাজের উপরের ভাগে বিমান উড়ানের জন্য যে রানওয়ে আছে, তার দৈর্ঘ্যও ৯০ মিটারের বেশি।

এর ফলে তেজসের মতো আধুনিক যুদ্ধবিমানও অনায়াসে ওঠানামা করতে পারবে এই বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ থেকে ওঠানামা করতে পারবে মিগ-২৯কে-র মতো যুদ্ধবিমানও।

মোট ৩০টি যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টার একসঙ্গে ওঠানামা করতে পারবে এই যুদ্ধজাহাজ থেকে। ৪৫ হাজার টনের এই যুদ্ধজাহাজ তৈরি করতে মোট খরচ হয়েছে ২০ হাজার কোটি রুপি।

২০১৩ সাল থেকে বিক্রান্ত তৈরির কাজ শুরু হয়। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ২০২১ সালের ৪ আগস্ট এই যুদ্ধজাহাজ প্রথম জলে নামে। এরপর আরও তিনবার জলে নামিয়ে পরীক্ষা চলে এই জাহাজের ওপর। সেসব পরীক্ষাতেই সফলভাবে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছিল বিক্রান্ত।

বিক্রান্ত হাতে এলে এই প্রথম দু’টি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের নিয়ন্ত্রণ পাবে ভারতীয় নৌসেনা। অন্যটি হলো, ২০১৪ রাশিয়া থেকে কেনা আইএনএস বিক্রমাদিত্য। সুতরাং বিক্রান্ত হাতে আসায় আরও শক্তিশালী হলো ভারতীয় নৌবহর। গত কয়েক বছর ধরেই চিনের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। লাদাখেও বারবার সংঘাতে জড়িয়েছে ভারত এবং চীনের সেনা।

প্রতিরক্ষা মহলের দাবি, সমুদ্রপথে যদি চীন কখনো ভারতকে আক্রমণের চেষ্টা করে তবে তা ঠেকাতে ভারতের ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ হতে পারে বিক্রান্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জন্য তৈরি করা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ হারকিউলিস পঞ্চাশের দশকে কিনেছিল ভারত। এটিই ছিল ভারতের হাতে আসা প্রথম বিমানবাহী রণতরী। তখন এর নাম বদলে রাখা হয় আইএনএস বিক্রান্ত।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে উজ্জ্বল ভ‚মিকা ছিল ভারতীয় নৌসেনার সেই বিক্রান্তের। প্রায় চার দশক কাজ করার পরে নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্বে বিক্রান্ত অবসর নেয়।

ভেঙে ফেলা হয় জাহাজটি। সেই পুরনো বিক্রান্তের স্মৃতিতেই প্রথম ‘ভারতীয়’ বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজটির নামও দেওয়া হয়েছে ‘বিক্রান্ত’। পুরোনো বিক্রান্তের লোহাও নতুন বিক্রান্তে ব্যবহার করা হয়েছে।

সর্বশেষ